রেলওয়ে স্টেশন যেন অপরাধীদের নিরাপদ অভয়ারণ্য। চুরি, ছিনতাই, যাত্রীদের ব্যাগ টানা–হেঁচড়া, মাদক কেনাবেচা ও পতিতাবৃত্তিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা এখানে ঘটে না। সন্ধ্যার পর রেলস্টেশনসহ আশপাশের এলাকা আরও ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রকাশ্যে চলে মাদক কেনাবেচা। পতিতাদের সর্দারের কাছে ফোন এলেই তিনি একেকজনকে পুরাতন রেল স্টেশন থেকে পাঠান রাস্তার বিপরীতে থাকা বিভিন্ন হোটেলে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের চোখের সামনে এসব অপরাধ ঘটলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না। অতীতে ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। রেল পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী আজাদীকে বলেন, রেল স্টেশনকে অপরাধমুক্ত করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এজন্য অভিযানও চলছে। একইভাবে জনগণকে সচেতন করতে আমরা লিফলেট বিতরণ, মতবিনিময় সভাও করছি। তবুও আপনি যেহেতু বলেছেন, আমি কালই বিষয়টি দেখবো।
অন্যদিকে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহিদুল কবীর আজাদীকে বলেন, রেল স্টেশনে অপরাধীদের অবস্থান ভেঙে দিতে পারলে ক্রাইম অনেকাংশে রোধ হবে। এখন দশ লাখ টাকার ছিনতাইয়ের আসামিও ধরা পড়ছে স্টেশন থেকে, হোটেলগুলোতে অভিযান চালিয়ে নারী পুরুষ যারা ধরা পড়ছে, তারাও দেখা যাচ্ছে আসছে স্টেশন থেকে। মাদক বিক্রি হচ্ছে স্টেশনে, মোবাইল ছিনতাই করে তা বিক্রির জন্য চোর যাচ্ছে স্টেশনে, সেখান থেকে মাদক কিনে সেবন করছে। শুধু তাই নয়, বড় কোনো চুরি ডাকাতির ভাগবাটোয়ারাও হয় গ্রামীণ মাঠে। এমন কোনো দিন নাই, যেদিন স্টেশন এলাকা থেকে কোতোয়ালী থানা পুলিশের হাতে কোনো না কোনো অপরাধী ধরা না পড়ছে।
রেলে চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীসহ স্থানীয়দের অভিযোগ, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের মূল ভবন ও প্ল্যাটফর্মগুলোর বেশিরভাগ জায়গা ঘিরে সক্রিয় রয়েছে একাধিক ভাসমান অপরাধী চক্র। বিভিন্ন সময়ে যাত্রী ও পথচারীদের মূল্যবান সামগ্রী ছিনতাই করে তারা। তবে খুব কমসংখ্যক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন। যারা অভিযোগ করেন তারাও যথাযথ প্রতিকার পান না। গত ১৯ ও ২৪ জুলাই রাতে পুরাতন রেল স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে যাত্রী গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়ি দরদাম করার সময় আরজু, মাইনু, সাইফুল, কালু, মুন্নাসহ কয়েকজন তাদের থেকে মোবাইল ও টাকা পয়সা ছিনিয়ে পালিয়ে যায়।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, সাধারণত আগে দেখা যেত বাস স্টেশনগুলোতে অপরাধীদের আনাগোনা বেশি। এখন চট্টগ্রাম রেল স্টেশন যেন সব ধরনের অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। গত সোমবার রাত দশটার দিকে সরেজমিন দেখা যায়, পুরাতন রেল স্টেশনের বিপরীত পাশে প্রবেশের সময় দেখা যায় জামে মসজিদের সামনে ভাসমান মানুষের জটলা। পুরাতন স্টেশনের মূল প্রবেশ পথে ভাসমান কয়েকটি দোকান। তারই ফাঁকে দেহবৃত্তিতে নিয়োজিত নারীদের সাথে দর কষাকষি করছে বিভিন্ন হোটেলের দালালরা। তাদের পাশেই নারীরা ভাত বিক্রি করছেন। এই জটলার স্থানটি স্থানীয় ভাবে গ্রামীণ মাঠ হিসেবে পরিচিত। সেখানে প্রকাশ্যে ইয়াবা বিক্রি করছেন চার–পাঁচজন নারী ও পুরুষ। বিক্রেতাদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। আবার নতুন স্টেশন থেকে পুরাতন স্টেশন আসার পথে দেখা যায় পেশাদার মাদকসেবীদের পাশাপাশি রিকশাচালক ও নিম্ন আয়ের মানুষকে গাঁজা ও ইয়াবা কিনতে ও সেবন করতে। এখানে গাঁজা বিক্রি করে সাহেদা নামে এক নারী। যার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা ঝুলছে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে। এখান থেকে খুব সহজেই ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ প্রায় সব ধরনের মাদক পাওয়া যায়। এ ছাড়া স্টেশনে চোরাই মার্কেটের পাশের সরু গলিতে কম টাকায় সহজে চোলাই মদ পাওয়া যায়। এ সময় মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে প্ল্যাটফর্মেও দেখা গেছে ভাসমান অপরাধীদের আনাগোনা। প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের আশপাশে তারা ঘোরাফেরা করছে। এসব অপরাধীর টার্গেট ট্রেনের যাত্রীরা। তবে বড় টার্গেট হলো নারী ও বয়স্ক পুরুষ যাত্রী।
অভিযোগ রয়েছে, ট্রেন ছাড়ার সময়ে জানালার পাশে থাকা যাত্রীদের মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান জিনিস ছোঁ মেরে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া ট্রেনের ভেতরে ও ছাদেও চলে ছিনতাইয়ের ঘটনা। সাধারণত স্বল্প আয়ের অনেক মানুষ টিকেট না পেয়ে ছাদে চড়ে বসেন। সেখানে তাদের থেকে মোবাইল ও টাকা–পয়সা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অনেক সময়ে ছিনতাইয়ে বাধা দিলে ছুরিকাঘাত করে চলন্ত ট্রেন থেকে তাদের ফেলে দেওয়া হয়।
রেলওয়ে থানার অদূরে গ্রামীণ মাঠে পাবলিক টয়লেটের পাশে ভাসমানদের আনাগোনা বেশি দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন বয়সের কয়েকশ অপরাধী।
রাজিফা সুলতানা নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, অফিস থেকে সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরার সময় অনেক ঝুঁকি নিয়ে আইসফ্যাক্টরি রোড যেতে স্টেশনের ফুটওভার ব্রিজটি পার হতে হয়। স্টেশন ছাড়াও সিঁড়িতে চলাচলরত পথচারীদের মোবাইল ফোন ও ভেনিটি ব্যাগ ছিনিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যায় ভাসমান ছিনতাইকারীরা। এ ছাড়া রাতে সিঁড়িতে বসে প্রকাশ্যে মাদক সেবন করে। তিনি বলেন, সবাইকে দোষারোপ করছি না। তবে কিছু অসাধু পুলিশ, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং রেলের অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে স্টেশনকে ঘিরে এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড চলছে বলে আমার ধারণা। এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডে সক্রিয় আছে অন্তত ৫টি চক্রের অর্ধশত সদস্য। চক্রের হোতাদের বিরুদ্ধে আছে একাধিক মামলাও। যাদের আড্ডাস্থল পুরাতন রেল স্টেশন সংলগ্ন গ্রামীণ মাঠ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলস্টেশন সংলগ্ন জিআরপি থানা ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যারাকের সামনে ছোট ছোট জটলা করেই প্রতিদিন বহু মানুষ অনলাইন জুয়া খেলায় ব্যস্ত থাকে। বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে গোল করে মাটিতে বসে চলে জমজমাট জুয়ার আসর। দিনমজুর ও শ্রমিকদের পাশাপাশি বিত্তবান পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানরাও অংশ নেয় এই জুয়ার আসরে। জুয়ার পাশাপাশি গভীর রাত পর্যন্ত চলে এখানে মদ ও বিভিন্ন নেশার আসর। অপরদিকে রেল স্টেশনে অবস্থিত দুই রেস্ট হাউস এখন পতিতালয় এবং মাদক ব্যবসার নিরাপদ জোনে পরিণত হয়েছে এমন জানায় এলাকাবাসী। তবে প্রতিদিন কিছু ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ঘটনায় থানায় মামলাও হয় না। ক্ষতিগ্রস্তরা থানা পুলিশ, আরএনবি এবং স্টেশন ম্যানেজারকে মৌখিকভাবে অভিযোগ দিয়ে চলে যায়।