চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্যের ভবনসহ ৫০টি বাস ভাঙচুরের ঘটনা এবং চবির ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ সংকট সম্পর্কে দৈনিক আজাদীর সম্পাদীয় কলামে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থা ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা এবং চবির ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের বিদ্যমান সংকট ও সমাধানে করণীয়’ শিরোনামে দুইটি লেখা ছাপা হয়। এবারের লেখার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন যা চবির হবু উপাচার্য নিয়ে যিনি অতি শীঘ্রই যোগদান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরবেন। সম্ভাব্য নামের তালিকা দেখে মনে হলো বয়সের দিক দিয়ে উপাচার্য মহোদয় আমার কনিষ্ঠ হবেন, তাই আমার অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পরামর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করলাম। আশা করি, আমার এই দুঃসাহস ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
উল্লেখ্য যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৭ জন উপাচার্য, ১২ জন উপ–উপাচার্য ও ৭ জন কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ছাত্রদের তোপের মুখে পদত্যাগ করেছেন চবির উপাচার্যসহ দুই উপ–উপাচার্য, প্রক্টরিয়াল বডি এবং সকল আবাসিক হলের প্রভোস্টবৃন্দ, ছাত্র উপদেষ্টা ও প্রেস প্রশাসক। গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সকল পদ খালি হয়ে যাওয়ায় সকল প্রকার একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় একটি পবিত্র স্থান আর উপাচার্য হলেন তারই একজন অভিভাবক। উপাচার্য পদটি সম্পূর্ণ প্রশাসনিক, যার কাজ হলো শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ও গবেষণার অনুকূল পরিবেশ তৈরি, গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধির চেষ্টা এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। উপাচার্য ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম চলতে পারেনা, তার জন্য দরকার সর্বগুণে গুণান্বিত একজন ব্যক্তি।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন ‘আমরা চাইবো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য হিসেবে সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা আসুক’। স্যার একজন জ্ঞানী–গুণী ও আদর্শ শিক্ষক হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। তিনি তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একাডেমিকভাবে যোগ্য এবং প্রশাসনিকভাবে দক্ষ, সৎ, শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নৈতিকভাবে সমর্থন করেছিলেন ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিবেন, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
এক্ষেত্রে দল নিরপেক্ষ প্রার্থী পাওয়া অসম্ভব, কারণ উপাচার্যের একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন, যা কোন দলের ছত্রছায়া ছাড়া নির্দলীয়ভাবে অর্জনের কোন সুযোগ নাই। আওয়ামী পন্থী ছাড়া বিএনপি–জামায়াত বা অন্যান্য সংগঠন থেকে উপাচার্য নিয়োগ পাবেন–এটাই স্বাভাবিক, তবে চবির বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা কেমন উপাচার্য চান এ প্রসঙ্গে সমন্বয়ক আব্দুল আওয়াল আলাওলের কথাগুলো বিবেচনার দাবি রাখে। এর সমন্বয়ক উপাচার্য সম্পর্কে বলেন “তিনি যেন শিক্ষার্থীবান্ধব হন অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তাঁর চিন্তা, কাজ, দক্ষতার জায়গাটা ব্যবহার করবেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে যেন দলীয়ভাবে অন্ধ ব্যক্তি না আসে। ন্যায় নীতির ভিত্তিতে প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় চালাবে কিন্তু কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী হবেন না”। চমৎকার প্রত্যাশা।
ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য নিয়োগের কাজ শুরু করেছেন। ঢাকা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইতোমধ্যে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রো–ভিসিসহ প্রশাসনের শীর্ষ পদে কারা নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন তা নিয়ে নানা মহলে চলছে আলোচনা। দি ডেইলি ক্যাম্পাসের তথ্য অনুযায়ী (২৮ আগস্ট) আলোচনায় রয়েছেন ৯ জন অধ্যাপকের নাম। আশা করা যায় অতি শীঘ্রই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হবে। যিনি দল মত নির্বিশেষে সকলের সহযোগিতায় বিদ্যমান সকল সংকট দূর করে একটা স্থিতিশীল শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করবেন। তবে তদবির এবং নাম বাছাইয়ের সমস্যা এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা, বয়স, অনার্স ও মাস্টার্সের ফলাফল, দেশের বাইরের কোন ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি, গবেষণার অভিজ্ঞতা, এবং বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষ ব্যক্তিদের বিবেচনায় আনতে পারেন। তবে অতি অল্প সময়ে যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে দৈনিক বার্তায় (২৭শে আগস্ট) ড. মো. মুনিবুর রহমান উল্লেখ করেছেন যে, ‘উপাচার্য নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা যেতে পারে‘, যেখানে প্রার্থীর যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ থাকবে। সার্চ কমিটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা শর্ট লিস্ট তৈরি করে দেবেন, তা থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সহজ হতে পারে। নিয়ম নীতি যাই হোক, উপাচার্য হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয় তাঁর প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে সকলের সহযোগিতা থাকবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন উপাচার্য মহোদয়কে কিছু সুপারিশ বিবেচনার জন্য তুলে ধরলাম :
১। যারা উপাচার্য, উপ–উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাবেন তারা যেন উক্ত পদে থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পরিবারসহ বসবাস করেন। তাতে শিক্ষার্থীদের সাথে উপাচার্যের মত বিনিময় এবং যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ বাড়বে, তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ব্যয়ও অনেকাংশে লাঘব হবে। অতীতে অনেক উপাচার্য কর্মস্থলের বাসায় বা ক্যাম্পাসে সার্বক্ষণিক অবস্থান না করে শহরে বসবাসের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অপ্রীতকর ঘটনা ঘটেছে। আমরা এই সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। উদাহরণস্বরূপ ৭ই সেপ্টেম্বর ২০২৩ এ চবির উপাচার্যের বাসভবনসহ ৫০টি বাস ভাঙচুরে প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষতিসাধন।
২। প্রক্টরিয়াল বডি এবং সকল আবাসিক হলের প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরগণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করবেন।
৩। অধ্যাপকের নিচের পদের কোন শিক্ষককে প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্বে না দেওয়া এবং আবাসিক হলগুলোর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে হাউজটিউটর নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রভোস্টদের মতামত নেওয়া।
৪। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ২টি শাটল ও ডেমো ট্রেনের পাশাপাশি বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করা।
৫। শাটল ট্রেনের লাইনটিকে জিরো পয়েন্ট থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত বর্ধিত করা এবং বগির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বটতলী ট্রেন স্টেশনের সংস্কার করা।
৬। ছাত্র– শিক্ষক মিলন কেন্দ্রকে (টিএসসি) একটি নতুন ভবন নির্মাণের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা।
৭। আবাসিক হলগুলোতে খাবারের মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করা।
৮। সেশনজট নিরসনে অনুষদ ভিত্তিক একাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরি ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা।
৯। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত প্রতিটি কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে ক্লাস শিক্ষককে মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা।
১০। প্রতিটি শিক্ষক নির্দিষ্ট সময়ে তাদের ওপর অর্পিত বিভিন্ন কোর্সের ক্লাস সমূহ নেওয়ার নিশ্চয়তার লক্ষ্যে প্রতিমাসে বিভাগীয় সভাপতির মাধ্যমে প্রতিবেদন নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
১১। উচ্চতর ডিগ্রী প্রদানের ক্ষেত্রে (এমফিলের জন্য ১টি ও পিএইচডির জন্য ২টি) পিয়ার রিভিউড ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে প্রকাশনা থাকা বাধ্যতামূলক করা।
১২। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে গবেষণা–প্রবন্ধ প্রকাশনার জন্য ফাস্ট অথরকে প্রতি প্রবন্ধের জন্য ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা উৎসাহ ভাতা প্রদান করা।
১৩। গবেষণার সুবিধার্থে ও গবেষণায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি রক্ষার্থে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে একটা বিকল্প বৈদ্যুতিক লাইন সংযোগের ব্যবস্থা করা।
১৪। বর্তমানে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তর খুব ঝুঁকিপূর্ণ, তার সুরক্ষার জন্য নূতন ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করা।
১৫। পরীক্ষার ফল প্রকাশ দ্রুত প্রকাশের লক্ষ্যে অটোমেশনের ব্যবস্থা করা।
১৬। বিদ্যুতের চাহিদা, সরবরাহ ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকী কমানোর লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র মিটার স্থাপন করা।
১৭। দুপুরের পরে ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ে যে বাস সমূহ (১৭ টি বাস) শহরে ঢুকে তাদেরকে পুনরায় ক্যাম্পাসে ফেরত না নিয়ে শহরে রাখার ব্যবস্থা করলে জ্বালানি খরচ বাবদ দৈনিক প্রায় ৭০ হাজার টাকার সাশ্রয় হবে এবং
মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের আদলে চবির ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজকে আধুনিকায়ন করা।
আশা করি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো প্রকৃত একাডেমিশিয়ান, সৎ, যোগ্য, চরিত্রবান এবং নেতৃত্বে অটুট থাকা ব্যক্তিদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদে নিয়ে আসবেন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংস্কারের লক্ষ্যে ছাত্র–শিক্ষকের রাজনীতি বন্ধসহ প্রশাসনিক কাঠামোকে দলীয়করণমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করবেন।
লেখক : প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়