‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় বইমেলা’: স্থানীয় লেখক ও নাগরিক-সমাজের অংশগ্রহণ জরুরি ছিলো

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ২৪ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হলো একটা বড় বইমেলা। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় সপ্তাহব্যাপী এই ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় বইমেলা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল মাঠে, গত ১৪ অক্টোবর থেকে ২০ অক্টোবর। মেলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থার ৭৫টি স্টল অংশগ্রহণ করেছে। অংশ নেয় বাংলা একাডেমিসহ সরকারি ১০টি প্রকাশনা সংস্থা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। এছাড়া ঢাকার ৪৭টি প্রকাশনা সংস্থা ও চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের আওতাভুক্ত ১৭টি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নেয়। স্টলগুলো ছিল খ্যাতিমান লেখকদের বই দিয়ে সাজানো। এরকম বইমেলা সত্যিই অভাবনীয়, সুন্দর, পরিপাটি, সাজানো ও পরিচ্ছন্ন। তবু এই বইমেলা চট্টগ্রামের লেখকপাঠকদের মধ্যে প্রত্যাশিত সাড়া জাগাতে পারেনি জেনে খারাপ লাগলো। আজাদীতে ২১ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মন খারাপ। বিকিকিনি একদম হয়নি।’ বলছিলেন এক প্রকাশনা কর্মী। মেলার শেষ দিনে অন্তত ১৫টি স্টলের বিক্রয়কর্মীর সাথে কথা হয় আজাদীর। সবার কণ্ঠেই ছিল প্রায় অভিন্ন সুর, বিক্রি তেমন হয়নি। এক্ষেত্রে ঢাকা থেকে আসা প্রকাশনা সংস্থার বিক্রয়কর্মীরা ছিলেন রীতিমত হতাশ। থাকাখাওয়াসহ অন্যান্য দৈনিক খরচও পোষাতে পারেনি বলে দাবি করেন তাঁরা।

আসলে এ ধরনের বইমেলা আয়োজনের ক্ষেত্রে লেখক, সংস্কৃতিকর্মী ও সুধীজনের অংশগ্রহণ জরুরি ছিল। তাঁদের সম্পৃক্ত করাতে পারলে মেলাটা সফল হতোতাতে কোনো সন্দেহ নেই। মেলার সময় নিয়েও ছিলো বড় সংকট। কোন্‌ সময়ে আয়োজন হলে মেলা ভালো জমবে সেটা হয়তো তাঁদের ধারণার মধ্যে ছিলো না। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ছক অনুযায়ী এই মেলার আয়োজন করতে গিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়। ছিলো তাড়াহুড়ো। আন্তরিকতার কোনো অভাব না থাকলেও মেলার সফলতা নিয়ে যাবতীয় দায় এসে পড়ে তাঁদের কাঁধে। মেলা শুরুর আগে সংবাদ সম্মেলন করে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোহাম্মদ শামীম আলম বলেছিলেন, ‘সপ্তাহব্যাপী বিভাগীয় বইমেলা আয়োজনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। মেলায় প্রতিদিন স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে রচনা, বিতর্ক, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতাসহ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমির অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।’ এই বক্তব্য থেকে বোঝা গেছে, এই মেলার বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় খুবই আন্তরিক ছিলো।

যদিও এ ক্ষেত্রে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ভূমিকাই বেশি। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর দেশের একজন প্রথম সারির কবি এবং চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান হওয়ার কারণে তাঁর কাছে চট্টগ্রামের লেখকসংস্কৃতিকর্মীদের প্রত্যাশা একটু বেশি ছিলো। তিনি অন্তত আগে থেকে তারিখ চাপিয়ে না দিয়ে ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় বইমেলা’ কখন আয়োজন করা যেতে পারে, সেবিষয়ে একটা মতবিনিময় করতে পারতেন। এখানে উল্লেখ করতে পারি, একই সময়ে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয় ৬দিনব্যাপী ‘শেখ রাসেল বইমেলা’। মেলাটি যত ক্ষুদ্রই হোক, একই সময়ে একই শহরে দুটো বইমেলা অনুষ্ঠিত হলে পাঠক বিভ্রান্তিতে পড়ার অবকাশ থাকে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তাঁদের এই বিভাগীয় বইমেলার মাধ্যমে চট্টগ্রামে লেখকপাঠকের একটা মিলনমেলার অয়োজন করতে পারতো। ‘করতে হবে বলেই করা’এমন অভিপ্রায় নিয়ে বইমেলার আয়োজন করতে গিয়ে হতাশ হতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। অবশ্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের আয়োজন নিয়ে নানাজন নানা কথা বলেছেন। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন, গত চার দশকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র লেখকদের সঙ্গে পাঠক ও প্রকাশকদের যোগাযোগ সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা নেই। বছরে কেবল একবার তারা কিছু বই কেনে। জেলা পর্যায়ে কোথাও কোথাও মেলা করে। তিনি বলেন, ‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বরাবরই বাজেট ও যোগ্য লোকের ঘাটতি থাকে। তবু সঠিক পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও দক্ষতা থাকলে অনেক কাজ করা যায়। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মধ্যে তেমন তাড়না দেখি না।’

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সম্পর্কে লেখক আবুল মোমেন বলেছেন, ‘গ্রন্থকেন্দ্রের কার্যক্রম দেখলে মনে হয়, এটি একটি অচল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চলেছে। একে কার্যকর করতে হলে বছরব্যাপী সুনির্দিষ্ট কাজের পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। জেলার মেলাগুলোর দায়িত্ব শুধু জেলা প্রশাসকদের ওপর না দিয়ে স্থানীয় নাগরিকসমাজ ও জেলাউপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তাদের যুক্ত করা দরকার। তাহলে বইমেলার সঙ্গে মানুষের একাত্মতা বাড়বে।’

তবে শুনে ভালো লাগলো যে, মেলায় বিকিকিনি না থাকলেও মেলার শেষ দিন আয়োজক কমিটি প্রতিটি স্টল থেকে দু’ হাজার টাকার বই কিনেছেন। এই বইগুলো প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়।

তবু এটুকু বলতে পারি, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাছে সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা বিষয়ে চট্টগ্রামের লেখকসংস্কৃতিকর্মীরা আশাবাদী। বর্তমানে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জনাব আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তিনি স্মার্ট জেলা উদ্ভাবন চ্যালেঞ্জে প্রথম হিসেবে শেখ রাসেল দিবসের উদ্বোধনী ও শেখ রাসেল পদক২০২৩ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ৮০ লাখ টাকার পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে ‘সমৃদ্ধ নগর, উন্নত গ্রাম, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় স্মার্ট চট্টগ্রাম’ স্লোগানকে সামনে নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতাধীন এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম কর্তৃক পরিচালিত দেশের জেলাসমূহের উদ্ভাবনী কার্যক্রম ভিত্তিক প্রতিযোগিতা ‘স্মার্ট জেলা উদ্ভাবন চ্যালেঞ্জ’ এর আওতায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ‘স্মার্ট স্কুল বাস’ নামক উদ্ভাবনী উদ্যোগটি প্রথম পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়।

স্মার্ট জেলা উদ্ভাবন চ্যালেঞ্জে প্রথম হওয়া চট্টগ্রাম সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেসেই প্রত্যাশা আমাদের। শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতিতে চট্টগ্রামের যেঐতিহ্য রয়েছে, তাকে তুলে ধরার নানা প্রয়াস জেলা প্রশাসন নিতে পারে। বই নিয়ে যত বেশি ও ফলপ্রসূ আয়োজন হবে, ততই মঙ্গল।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী।

ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবহুমাত্রিক মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী
পরবর্তী নিবন্ধম্যাচ রেফারী ও ম্যাচ কমিশনার সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি