চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড, এ হৃদপিণ্ডের চিকিৎসা দরকার

নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল পরিদর্শনের পর মতবিনিময়কালে ড. ইউনূস বন্দর পরিচালনায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করলে দেশের লাভ পেছনে থেকে অনেকে আমাদের ডিঙ্গিয়ে গেছে, এটার পরিবর্তন করতে হবে

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৫ মে, ২০২৫ at ৭:৪১ পূর্বাহ্ণ

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। কিন্তু এ হৃদপিণ্ডকে বিশ্বসাইজের হৃদপিণ্ড হতে হবে। এই হৃদপিণ্ডকে আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। এজন্য আমি নেপাল ও ভারতের সাতটি উত্তরপূর্ব রাজ্যের (সেভেন সিস্টার্স) কথা বলেছি। যদি তারা এতে যুক্ত হয়, তারা উপকৃত হবে, আমরাও হব। যারা যুক্ত হবে না, তারা পিছিয়ে পড়বে।

গতকাল বুধবার সকালে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিদর্শনের পর বন্দর ও নৌপরিবহন খাতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, মাঝে মাঝে প্রশ্ন শুনি যে, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আপনারা ইন্ডিয়াতে স্বাস্থ্যের জন্য যান না? দলে দলে যান, যখন বন্ধ করে দিয়েছে তখন বলছেন কেন যেতে দিচ্ছে না? কাগজ উল্টালে দেখা যায়, নেতারা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে, ব্যাংককে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। কিন্তু বন্দরের কথা যখন আসে, না না এখানে কেউ আসতে পারবে না। ভাই, আমাদের চিকিৎসা দরকার তো। এ হৃদপিণ্ডের চিকিৎসা দরকার। এটার পেছনে আমাদের বিশ্বের সেরা চিকিৎসক দিতে হবে, যেন এটাকে বিশ্বসাইজের হৃদপিণ্ড বানিয়ে দেওয়া হয়, কোনো সমস্যা যাতে না হয়। এ হৃদপিণ্ড ক্রমাগত মজবুত হবে, ক্রমাগত শক্তিশালী হবে, ক্রমাগত বৃহত্তর হবে। পৃথিবীতে অনেকে আমাদের পেছনে থেকে অনেক খারাপ অবস্থা থেকে এখন আমাদের ডিঙ্গিয়ে শত শত মাইল চলে গেছে। তাহলে আমরা কেন হতভাগা জাতি হলাম? এটার পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের অনেক বড় ডাক্তার দিয়ে কাজ করতে হবে।

. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বন্দর ব্যবস্থাপনায় পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে, যেভাবেই হোক। মানুষ রাজি না থাকলে তাদের রাজি করাতে হবে। মানুষকে গররাজি করিয়ে করার দরকার নেই, রাজি করিয়েই করতে হবে। এটা এমন একটা বিষয়, পুরো বিষয়টা শুনলে গররাজি হওয়ার কোনো কারণ নেই। সবাই চায় তার ভালো হোক। না বোঝার কারণে বলে যে, এটা ভালো হবে না, এটা আমাদের ক্ষতি হবে, ওটাতো আমাদের ছিল, ওটা কেন দিয়ে দিচ্ছেন? কিন্তু যখন দেখবে এটা সবার জন্য ভালো হবে, তাহলে আপত্তি থাকবে না। দুনিয়ার সব জিনিস এত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, আমাদের এখানে এটা (চট্টগ্রাম বন্দর) পাল্টায় না কেন? এটা আজকের প্রশ্ন না। একজন চট্টগ্রামবাসী হিসেবে এ পথে আসাযাবার ক্ষেত্রে দেখা হয়বিশেষ করে যখন গাড়ি চলে না, আটকে যায়, কী হল? ট্রাকে ভর্তি রাস্তা, মাল খালাস করতে পারছে না। এদিকে প্লেন মিস করে ফেলব কিনা, এই দুর্ভাবনা। কাজেই এটা সম্পর্কে চিন্তা না করে উপায় নেই। কথাবার্তা বলেছি, মাঝে মাঝে লেখালেখি করেছি। তো এবার যখন সুযোগ পেয়েছি, প্রথমদিন থেকেই চেষ্টা করছি এটার দিকে নজর দেওয়ার, কীভাবে এটাকে পরিবর্তন করা যায়।

তিনি আরো বলেন, বন্দর পরিচালনায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করলে দেশের লাভ হবে। কারণ এর পেছনে আমাদের কোনো টাকাপয়সা খরচ লাগবে না। বিল্ড, অপারেট এন্ড ট্রান্সফার। তোমরা বানাও, তোমরা কাজ কর, রোজগার কর, এই মেয়াদের মধ্যে আমাদের দিয়ে দিতে হবে। আমরা এক পয়সাও খরচ করবো না। তখন আমাদের পয়সা বেঁচে গেল, কাজটা হয়ে গেল। তারা যখন কাজে নামবে, তারা দুনিয়াতে শত শত পোর্ট পরিচালনা করে, ওরা হল দুনিয়ার সেরা। যাদের সঙ্গে আমরা কথা বলছি, তারা হল দুনিয়ার সেরা। পৃথিবীর যে কোনো বন্দরে যান, তাদের মার্কা দেখবেন। সুতরাং তারা যখন দায়িত্ব নেবে, তারা আমাদের মতো করে পরিচালনা করবে না। আমরা যখন লিজ দেব, তখন সেটা তাদের বন্দর, এটা থেকে তাদের টাকাটা ওঠাতে হবে, তারা তাদের সেই প্রযুক্তি দিয়ে বানাবে। তারা আগে যত বন্দর বানিয়েছে, টার্মিনাল বানিয়েছে, এরপর তাদের সর্বশেষ প্রযুক্তি, সর্বশেষ অভিজ্ঞতা এখানে আনবে। তাদের লক্ষ্য থাকবে, এই বন্দর আমরা এমনভাবে করবো, যাতে টাকাটা ওঠাতে পারি, আরও বেশি টাকা ওঠাতে পারি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিদেশিরা যে আসছে, তারা কি তাদের দেশ থেকে লোকজন নিয়ে আসবে? বন্দর চালাতে হলে আমাদের লোকই চালাবে। এটা থেকে গত্যন্তর নেই। আমাদের লোকদের শিখিয়ে দিলে খুব সহজে শিখে নেবে, খরচ কম। ইউরোপ থেকে শ্রমিক এনে যদি আমাদের বন্দর চালাতে হয় সেই ব্যবসা লাটে উঠবে। বন্দর বড় হবে, ক্যাপাসিটি বড় হবে। প্রযুক্তি সত্ত্বেও আগে যেখানে একজন লোক লাগতো এখন বন্দর বড় হওয়ায় পাঁচজন লাগবে। আমি বলি, আজ সই করে দিলেও পাঁচ বছর লাগবে বন্দর হিসেবে পরিচালনা করতে। ধরলাম ২০৩০৩১ সাল। সত্যিকার ফুল স্পিডে কাজ শুরু হবে পাঁচ বছর পর। আমাদের লোকজন এর মধ্যে অভিজ্ঞ হবে। ক্রমে তাদের ওপর ভরসা করবে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, ২০৩১ সালে তারা কর্মক্ষম হয়ে যাবে, সব কিছু চালু হয়ে যাবে। ২০৩৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর যত দেশে যত বন্দর তারা চালায়, এসব টপ কোম্পানিতাদের বহু জায়গাতে বাংলাদেশিরাই পরিচালনা করবে। তাড়াতাড়ি বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা আছে আমাদের লোকদের। যে বন্দরে পা দাও, দেখবে পরিচালনা করছে বাংলাদেশি। কোথা থেকে এসেছে? চট্টগ্রাম বন্দর থেকে। চাকরি কমবে নাকি চাকরি বাড়বে? আমরা বুঝতে চাই না কেন। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে এটা করবে। আমাকে দরখাস্ত নিয়ে ঘুরতে হবে না। যারা ভালো কাজ করবে পরিবারসহ নিয়ে যাবে। যে জায়গা খালি হবে সেখানে আরেক বাংলাদেশি চাকরি পাবে। কাজেই বিরাট একটা সুযোগ আমাদের।

নৌ পরিবহন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের আশেপাশে একাধিক টার্মিনাল নির্মাণ কনটেইনার জট কমাতে সাহায্য করবে। আমি আশা করি আগামী ছয় মাসের মধ্যেই আপনি পরিবর্তন দেখতে পাবেন।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, বন্দরের আধুনিকায়নের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য এবং তার ৯৮ শতাংশ নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দিয়ে সম্পন্ন হয়। প্রাকৃতিক কারণে ২০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না। এ কারণে বিশ্ব ব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম রেঞ্জ ও সিএমপিতে চালু হচ্ছে অনলাইন জিডি
পরবর্তী নিবন্ধকালুরঘাটে রেল-কাম সড়ক সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন