চট্টগ্রাম ঘিরে বড় সম্ভাবনা

হালিশহর করা যায় পাতায়ার চেয়ে বড় বিচ ।। মীরসরাই-কক্সবাজার সংযোগ বাড়ালে আসবে লক্ষ কোটি পর্যটক ।। দরকার ঐক্যবদ্ধ সুযোগ নেতৃত্ব ।। এলইডি বাল্ব বিতরণ উদ্বোধনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৩ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

‘চট্টগ্রামের উন্নয়নের সাথে বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারিত’ বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। আমরা বুঝি, বাংলাদেশের উন্নয়ন যদি করতে হয় চট্টগ্রামকে গুরুত্ব দিতেই হবে। চট্টগ্রাম বন্দর যদি না থাকত অর্থনীতিতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন একেবারেই অসম্ভব ছিল।
চীন সরকার হতে অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত এলইডি বাল্ব বিতরণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। গতকাল শনিবার দুপুরে নগরের রেডিসন ব্লুর মেজবান হলে এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুস সালাম ও স্থানীয় সরকার চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, পৃথিবীতে বেশ কিছু ল্যান্ড লক কান্ট্রি আছে, যাদের অপরচুনিটি অনেক বেশি। প্রটেনটিশয়ালিটি থাকা সত্ত্বেও সেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, জাতির জনক স্বপ্ন দেখেছেন চট্টগ্রামসহ সারা দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার। সেদিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ ছিল হতদরিদ্র দেশ, আমাদের মাথাপিছু আয় ৫০০ ডলারের নিচে ছিল। সেটা আজ দুই হাজার ডলারে উন্নীত হয়েছে। মারাত্মক খাদ্য ঘাটতি ছিল, এখন খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ। আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বেশ উন্নতি হয়েছে। সার্বিকভাবে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছে বাংলাদেশ। এই উন্নতির ধারা অব্যাহত রেখে ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ব। সেই লক্ষ্যে পৌঁছুতে প্রধানমন্ত্রী যে পথনকশা রচনা করেছেন সে পথ ধরে বাংলাদেশ হাঁটছে। তার সাথে চট্টগ্রামও একীভূতভাবে কাজ করবে।
মন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য যেভাবে কাজ করব তেমনি এখানকার নাগরিকদের উন্নত জীবনযাপনে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করতে হবে। চট্টগ্রামের নালা-নর্দমা, খাল-বিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে। ময়লা-আর্বজনা, কচুরিপনা পরিষ্কার করতে হবে। খালের দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে করে সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা হলে পানিটাও পরিষ্কার থাকবে এবং মানুষও হাঁটতে পারবে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারবে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক অপরচুনিটি আছে। সেটা কাজে লাগানোর জন্য লিডারশিপকে কাজ করতে হবে। পরিষ্কার নগরী হলে মনটাও পরিষ্কার থাকবে। সব মানুষ যদি একসাথে ভালো কাজ করে পিছিয়ে পড়ার সুযোগ নাই।
দেশের কোনো অঞ্চলকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম বা ঢাকা সবগুলোর উন্নয়ন একীভূত করতে হবে। ঢাকা যদি খারাপ থাকে বা চট্টগ্রাম যদি বঞ্চিত হয় তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে না। সে কারণে সবগুলোকে কালেক্টিভ এফোর্ট (সম্মিলিত প্রচেষ্টা) দিয়ে কাজ করার জন্য অঙ্গীকার করতে হবে।
মীরসরাই ইকোনমিক জোনে পানি সরবরাহ নিশ্চিতে চট্টগ্রাম ওয়াসার গৃহীত ‘মোহরা পানি শোধনাগার ফেইজ-২’ প্রকল্পের জন্য হালদা নদী থেকে পানি উত্তোলন করলে সমস্যা হবে না জানিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, মীরসরাই ইকোনমিক জোন, সেখানে ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের একটা ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেটাকে কার্যকর করার জন্য, সুফল আহরণের জন্য আমাদের মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। সেটা করতে গেলে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির সুবিধা আপনাকে দিতে হবে। এসব ইউটিলিটিক্যাল সাপোর্ট প্রোভাইড করার জন্য সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং করা ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, হালদা নদীতে প্রতি সেকেন্ডে ৩৭০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। সেখান থেকে ৩ দশমিক ৭ কিউসেক পানি যদি মীরসরাই ইকোনমিক জোনের জন্য দেওয়া হয়, তাহলে ওয়াটার ফ্লুতে কোনো সমস্যা হবে না। হালদা নদীতে মাছের প্রজনন হয় এপ্রিল, মে এবং জুন মাসে। সে সময় অতিরিক্ত পানি থাকে। শুষ্ক সময়ে যখন পানি কম থাকে তখন কিন্ত মাছের প্রজনন হয় না। তিনি বলেন, উন্নয়নের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে হবে। উন্নয়নের প্রতিবন্ধক বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্ত ধারণা বা ভুল বোঝাবুঝি হলে আমাদের সবাইকে ভুগতে হবে।
ভ্রান্ত ধারণার কারণে অনেক সময় উন্নয়ন ব্যাহত হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির দায় সবাইকে বহন করতে হবে। মীরসরাই শিল্পনগর হচ্ছে, টানেল হচ্ছে, আরও উন্নয়ন হচ্ছে চট্টগ্রামে। বিলিয়ন ডলার ইনকাম করার সুযোগ আছে চট্টগ্রাম থেকে। তার জন্য ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি না করে এখন থেকে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমেই সেটা করতে পারব। একসময় রামপাল নিয়েও অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয়েছে।
থাইল্যান্ডের পাতায়া বিচের সাথে চট্টগ্রামের তুলনা করে তিনি বলেন, পাতায়াতে কী আছে? সুন্দর কৃত্রিম বিচ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও শপিং মল। এই বিচের চেয়ে অনেক বড় বিচ চট্টগ্রামের হালিশহরে করা যায়। যদি করা সম্ভব হয়, মীরসরাই থেকে কানেক্টিভিটি যদি কক্সবাজার পর্যন্ত বাড়ানো যায়, তাহলে এখানে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি ট্যুরিস্ট আসবে। একজন ট্যুরিস্ট যদি প্রতিদিন ১০০ ডলার খরচ করে তাহলে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা আয় হবে। অর্থাৎ এখানে বিলিয়ন ডলার আয় করার সুযোগ আছে। এ সুযোগটাকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। যেসব লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া দরকার সেজন্য সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।
মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঠিক নেতৃত্বের কারণে মিয়ানমার থেকে সমুদ্রসীমা অর্জন করতে পেরেছি। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। তার নেতৃত্বে উন্নত বাংলাদেশ ও সোনার বাংলা হবে। সেজন্য আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। যার যে কাজ দেয়া আছে সেটা পালন করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশ ভালো থাকলে আমি-আপনি ভালো থাকব। তিনি বলেন, কোনো শ্রেণি ভালো থাকবে, অন্য শ্রেণি বঞ্চিত হলে হবে না। সবাইকে ভালো থাকতে হবে। করোনাভাইরাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ভাইরাস এক জায়গায় সংক্রমিত হলে সেটা ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, এলইডি বাল্ব বিতরণ চট্টগ্রাম থেকে শুরু করা হলো। আমরা চট্টগ্রামকে সবার আগে আলোকিত করতে চাই। চট্টগ্রাম আলোকিত হলে সারা দেশ আলোকিত হবে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে এমন প্রকল্প নিতে চাই আমরা। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমরা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি, যেখানে বলা আছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। একইসাথে তাদের রাজস্ব আহরণ করতে হবে। কারণ স্থানীয় সরকারগুলো নিজের টাকায় নিজে না চললে কেন্দ্রীয় সরকারের বোঝা হয়ে যাবে।
চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, আগামী ১০ বছরে চট্টগ্রাম হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠ শহর। তিনি বলেন, একসময় টানেল ছিল স্বপ্নের বিষয়। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে চায়না। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশ ও মূল শহরের সাথে সংযোগ করে টুইন সিটি করার পথ সুগম হচ্ছে। চট্টগ্রাম হবে সিঙ্গাপুরের চেয়ে উন্নত। চীনের কুমিং টাউন পর্যন্ত রেল ও সড়ক যোগাযোগ হয়ে গেলে এই নগরী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বেশি আলোকিত ও সমৃদ্ধ নগরী হবে। কর্ণফুলী টানেল হয়ে গেলে মূল শহরের পাশে আরো গুচ্ছ শহর গড়ে উঠবে।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সাল। ২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। ২১ সালে পদ্মা সেতু হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বছরটি শুরুতে আমাদের কাছে আলোর বার্তা নিয়ে এসেছে।
স্থানীয় সরকার চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, এলইডি বাতি ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে ‘প্রভিশন অব গুডস ফর এড্রেসিং দ্যা ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শীর্ষক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। এর আলোকে বাংলাদেশকে ১৩ লাখ সাড়ে ১২ হাজার এলইডি বাল্ব দিয়েছে চীন। সম্প্রতি চীনের নিজস্ব জাহাজে করে বাল্বগুলো বাংলাদেশে পাঠানো হয়। গতকাল বাল্বগুলো স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন সারা দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সিটি কর্পোরেশনসহ চট্টগ্রাম জেলার ২২৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিতরণ করা হয়েছে ৫৫ হাজার ১০০টি বাল্ব। প্রতিটি বাল্ব ৭ ওয়াটের। সিটি কর্পোরেশনকে ৪ হাজার, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদকে ৩০০টি, ১৫টি উপজেলার প্রতিটিকে ৪০০ করে ৬ হাজার, ১৫টি পৌরসভার প্রতিটিকে ৪০০ করে ৬ হাজার, ১৯২টি ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটিকে ২০০ করে ৩৮ হাজার ৪০০ এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে দেয়া হয়েছে ৪০০ বাল্ব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্বাচন এলেই অভিযোগের বাক্স খুলে বিএনপি
পরবর্তী নিবন্ধফ্লাইওভারে ওঠার মুখে প্রাণ গেল শ্রমিকের