চট্টগ্রামে সর্বস্তরের মানুষ বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করেছেন ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের। ভাষার ঋণ শোধের অনুভূতি নিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই ফুল হাতে চট্টগ্রামে নতুন আঙ্গিকে সজ্জিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছুটে যান সর্বস্তরের মানুষ। মায়ের ভাষা বাংলার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন সেই শহীদদের স্মরণ করেছে নারী–পুরুষ–শিশু থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা সবাই একত্রিত হন শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিয়ে।
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে একুশের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিটে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দিন এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদা খানম পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদি উর রহিম জাদিদ প্রমুখ।
এরপর সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমন্বয়ক, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবসহ সরকারি–বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সাথে নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর মহানগর বিএনপি, বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, সামাজিক, পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা নিবেদন পূর্বে সিটি মেয়র সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারদের আত্মত্যাগ, একাত্তরে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া লাল–সবুজের পতাকা, নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আর চব্বিশের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে ঐক্যের বিকল্প নেই। ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব।
জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অনেক রক্তের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আমরা সবাই মিলে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে কাজ করব।
জেলা প্রশাসনের আলোচনা সভা : শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন। সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম। আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদ।
বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, ঐতিহাসিকভাবে ভাষার সাথে সভ্যতার সম্পর্ক রয়েছে। একইসাথে ভাষা সংরক্ষণে আর্কাইভ ও গবেষণার গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের জাতিকে যদি উন্নত করতে চাই, আমাদেরকে বিশ্বের সব ভাষার সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করতে হবে।
বিশেষ অতিথি চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ ভাষার শুদ্ধ চর্চা ও সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় একটি ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় প্রদর্শিত বিলবোর্ড, পোস্টার ও সাইনবোর্ডে ইংরেজির বহুল ব্যবহার ও বাংলা ভাষার অপব্যবহার দেখা যাচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের মর্যাদা রক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচলন ও এর অপব্যবহার বন্ধের আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, ভাষার ব্যবহার যদি বাধাগ্রস্ত হয়, সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হবে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাস নয়, সারা বছর শুদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য আহ্বান জানান তিনি।
সভা শেষে জেলা শিশু একাডেমি ও জেলা শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত শুদ্ধ বাংলা বানান, চিত্রাঙ্কন ও কুইজ প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন গ্রুপের বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত ডিআইজি মুহাম্মদ ফয়সাল আহম্মেদ, জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকবৃন্দ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব : চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের অন্তর্বর্তী কমিটির আহ্বায়ক ফরিদা খানম এবং অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচির নেতৃত্বে একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে কর্মসূচি শুরু হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতভাবে রাখা হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে শুরু হয় প্রেস ক্লাব সদস্যদের সন্তানদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। দুপুরে সদস্যদের স্ত্রীদের মিউজিক্যাল পিলো ছাড়াও সন্তানরা উন্মুক্ত ছড়া, কবিতা, আবৃত্তি ও গান পরিবেশন করেন।
বিকালে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর সকল সাইনবোর্ড বাংলায় প্রচলন নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন প্রদত্ত ট্রেড লাইসেন্সও বাংলা ভাষায় করা যায় কিনা সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম নতুন প্রজন্মকে বাংলা চর্চায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য উদ্যোগী হতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
একুশে উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও প্রেস ক্লাব অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য গোলাম মাওলা মুরাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ক্লাবের অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য মুস্তফা নঈম, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ ও সাধারণ সম্পাদক সালেহ্ নোমান। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা তিনটি ক্যাটাগরিতে অনুষ্ঠিত হয়। কেজি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান ইমাদুল ইসলাম খালিদ (দ্বিতীয় শ্রেণি), দ্বিতীয় উম্মে কুলসুম রাইসা (পঞ্চম শ্রেণি), তৃতীয় আবু শহরুল (প্রথম শ্রেণি)। এই বিভাগে উৎসাহমূলক পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলো ইশরাফুল হক স্বাদ (কেজি), নুমাইর আব্দুল্লাহ (কেজি), জোনায়েদ আলম নিবরাজ (তৃতীয়)। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়েছেন ইসরাত ইসলাম নিঝুম (নবম), দ্বিতীয় এ কে এম ইহসান আরেফিন (সপ্তম) এবং তৃতীয় মালিহাতুস সাদিয়া (এসএসসি)। একাদশ থেকে তদুর্ধ্ব ক্যাটাগরিতে প্রথম হামীম হাসান (দ্বাদশ), দ্বিতীয় সাফোয়ান হাসান (একাদশ), তৃতীয় আতিয়া আফিফা জাহান (অনার্স)। বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক যুবরাজ (জাহেদ এ চৌধুরী) ও লিটল জুয়েলস স্কুলের শিক্ষক নুসরাত জাহান।