চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেল লাইনের অধীনস্থ কক্সবাজারের চকরিয়া রেল স্টেশন উদ্বোধন হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন স্থানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণকৃত ভূমি দখল করে নেওয়া হয়েছে। মৌজা রেটের তিনগুণ দাম দিয়ে অধিগ্রহণকৃত এই ভূমিতে ইতোমধ্যে স্থাপনাও নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক স্থানে। অধিগ্রহণকৃত বিপুল পরিমাণ এই ভূমির বেদখল ঠেকাতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো হস্তক্ষেপ বা দখলবাজদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই অবস্থায় আরও বিপুল পরিমাণ অধিগ্রহণকৃত ভূমি বেদখল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণকৃত ভূমি বেদখল হয়ে যাওয়ার তথ্য পেয়ে উপজেলার সাহারবিল ইউনিয়নস্থ চকরিয়া রেল স্টেশন এলাকায় গেলে চোখে পড়ে একাধিক স্থানে দখলদারিত্ব। সরেজমিনে দেখা যায়, চকরিয়া–বদরখালী–মহেশখালী সড়কের ওপর দিয়ে যাওয়া রেল লাইনের কালভার্টের উত্তর–পশ্চিম পাশে (সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে) ইতোমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক দোকানঘর। আবার খোদ রেল স্টেশনের পশ্চিম পাশে স্টেশনের অনতিদূরে অন্তত এক একর পরিমাণ জায়গা দখলে নিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে গবাদি পশু পালনের খামার। রেল লাইনের কাজ শুরু হওয়ার পরপরই খননকৃত বিশালায়তনের পুকুরটিও দখলে রেখে সেখানে চাষ করা হচ্ছে মাছের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাহারবিলস্থ চকরিয়া রেল স্টেশনের পশ্চিম পাশের স্থানীয় বাসিন্দা রেজাউল করিম ও মাহমুদুল করিম নামের দুই ভাই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এই জায়গা দখলে রেখে সেখানে গবাদি পশু ও পুকুরে মাছের খামার গড়ে তুলেছেন। এই দুই ভাই স্থানীয়ভাবে বেশ প্রতাপশালী এবং তারা ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতির সমর্থক বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। মূলত রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি খাটিয়ে রেলওয়ের এই বিপুল পরিমাণ ভূ–সম্পত্তিতে তাদের থাবা প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রেললাইন নির্মাণে নিয়োগকৃত দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি হচ্ছে তমা গ্রুপ। এই তমা গ্রুপ চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ শুরু করে। এজন্য তমা গ্রুপ সাহারবিলস্থ চকরিয়া স্টেশনের পশ্চিম পাশে সাহারবিল মৌজায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণকৃত এক একরের এই জায়গায় প্রথমে বেইস ক্যাম্প নির্মাণের অংশ হিসেবে এল আকৃতি করে বিশাল পরিসরে অন্তত ১০টি সেমিপাকা টিনশেড নির্মাণ করে। একইসঙ্গে খনন করা হয় বিশাল একটি পুকুরও। রেল লাইন নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপ তল্পিতল্পা গুটিয়ে রেলওয়ের এই ভূমির দখল ছেড়ে চলে যান গত বছরের আগস্টের দিকে। তবে তাদের নির্মিত সেমিপাকা টিনশেডগুলো রেলওয়ে ভূমিতে থেকে যায়। এমনকি সেই ভূমিও তমা গ্রুপ স্টেশন কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়নি বা অপসারণও করেননি।
অভিযোগ ওঠেছে, তমা গ্রুপের ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. রাশেদুজ্জামান এবং আরেক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এই জায়গার বিনিময়ে দখলদার রেজাউলদের কাছ থেকে হাতিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। মূলত এই টাকার বিনিময়ে তমা গ্রুপের কাছ থেকে রেলওয়ের জায়গায় নির্মিত বেইস ক্যাম্পের ওইসব সেমিপাকা টিনশেড ঘরগুলো এবং খননকৃত পুকুরটি দখলে নিয়েছেন দখলদারেরা।
এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় চকরিয়ার উত্তর হারবাংস্থ তমা গ্রুপের স্থানীয় প্রধান কার্যালয়ে। কার্যালয়ে অবস্থান করা জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা হলে তিনি দাবি করেন– তমা গ্রুপ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে এখনও শতভাগ কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। হয়তো আগামী বছরের (২০২৬ সাল) ফেব্রুয়ারি–মার্চের দিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে সমুদয় কাজ বুঝিয়ে দেবেন। তিনি বলেন, সাহারবিলস্থ চকরিয়া স্টেশনের পশ্চিম পাশে রেলওয়ের অধিগ্রহণকৃত জায়গায় তমা গ্রুপ পুকুর খননসহ যে বেইস ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন, তা বর্তমানে অকার্যকর। প্রায় এক বছর আগেই সেখান থেকে তমা গ্রুপের সংশ্লিষ্টরা চলে এসেছেন। তবে আমাদের (তমা গ্রুপ) নির্মিত বেইস ক্যাম্পের স্থাপনাগুলো অপসারণ না করে স্থানীয়দের ভাড়া দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের ভূমি যখনতখন নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে। তবে রেলওয়ের অধিগ্রহণকৃত ভূমি কাউকে দখল দেওয়া হয়নি এবং এই ভূমি কাউকে দখল দেওয়ার এখতিয়ারও আমাদের নেই।
তমা গ্রুপের আরেক কর্মকর্তা (ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার–ডিপিএম) মো. রাশেদুজ্জামান মুঠোফোনে দাবি করেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ওই জায়গায় নির্মিত তমা গ্রুপের বেইস ক্যাম্প স্থাপন করতে গিয়ে অঢেল টাকা খরচ হয়েছে। সেই বেইস ক্যাম্পে বর্তমানে তমা গ্রুপের কোনো লোক না থাকায় স্থাপনাগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে গতবছরের সেপ্টেম্বরের দিকে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চে যখন রেল লাইনের শতভাগ কাজ কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে তখন সবকিছুই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের হয়ে যাবে। তাই বেইস ক্যাম্পের ভূমিও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় সচেতন নাগরিকেরা দাবি করেছেন– রেলওয়ের অধিগ্রহণকৃত এই জায়গাটি (তমা গ্রুপের বেইস ক্যাম্প) কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে নেই। এই সুযোগের সদ্ব্যবহারও করছে স্থানীয় অপরাধীরাও। দিনের বেলায় অপরাধীরা এখানে অবস্থান করে সুযোগ বুঝে দিনে ও রাতে রেল স্টেশন এবং আশপাশের এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করছে। গত একবছরে এই রেল স্টেশনে অন্তত শতাধিক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এই বেইস ক্যাম্প থেকেই এসব অপরাধীরা তা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিমত স্থানীয়দের।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের জায়গা দখলে রেখে গবাদি পশু পালন ও পুকুরে মাছের খামার গড়ে তোলা নিয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত রেজাউল করিম ধমকের সুরে বলেন, আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ কে করেছে এবং তুমি (প্রতিবেদক) কোন সাহসে এই কথা আমাকে বললে তা আমাকে সরাসরি বলতে হবে। তা না হলে কী করতে হবে তা আমার জানা আছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সাহারবিলস্থ চকরিয়া স্টেশন মাস্টার মো. ফরহাদ চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখনও রেল লাইন নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপের কাছ থেকে সবকিছুই বুঝে পায়নি। তাই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণকৃত জায়গায় তমা গ্রুপের নির্মিত বেইস ক্যাম্পের টিনশেড সেমিপাকা স্থাপনাগুলো এবং পুকুরটিও আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। তিনি বলেন, রেলওয়ের জায়গাটি তমা গ্রুপ কোনো ব্যক্তির কাছে ভাড়া দিয়েছেন কী–না এবং সেই বেইস ক্যাম্পে কারা অবস্থান করছেন তাও আমি জানি না। এই বিষয়টি লিখিত এবং মৌখিকভাবে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।