কক্সবাজারের চকরিয়ার বিলুপ্তপ্রায় সুন্দরবন তথা চিংড়ি জোনে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব ও লুটপাট অব্যাহত রয়েছে। দুইমাস আগে থেকে শুরু হওয়া সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের এই অপতৎপরতায় ঘের মালিক–কর্মচারী ও চিংড়ি চাষিদের তাড়িয়ে দিয়ে জবর–দখল করে নেওয়া হয়েছে অন্তত ১০ হাজার একর চিংড়ি ঘের।
সর্বশেষ গত বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে বারোটা থেকে বৃহস্পতিবার ভোররাত পর্যন্ত চিরিঙ্গা ইউনিয়নের চরণদ্বীপ মৌজার গোলদিয়ায় ১০ একর বিশিষ্ট সাতটি ঘেরে (৭০ একর) হানা দেয় ২০ সদস্যের একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল। এ সময় তারা অন্তত শতাধিক ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এর পর একে একে ঘেরগুলো দখলে নেয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে এসব ঘের থেকে মাছ লুট করে নেয় সন্ত্রাসীরা।
ঘের কর্মচারীরা জানান, সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঘেরে হানা দিয়ে প্রথমে সহকারী পরিচালক সালাহউদ্দিনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ও পিটিয়ে হাত–পা বেঁধে ফেলে। এর পর এসব ঘেরে একযোগে তাণ্ডব ও লুটপাট চালায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। লুট করে নিয়ে যায় মাছ, জালসহ অন্তত পাঁচ লক্ষাধিক টাকার মালামাল।
এই ঘটনায় ভুক্তভোগী ঘের মালিক চকরিয়া উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এসোসিয়েশনের সভাপতি ও সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় একটি এজাহার দায়ের করেছেন। সন্ত্রাসীদের পিটুনিতে আহত ঘেরের সহকারী পরিচালক সালাহউদ্দিনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
এজাহারে চকরিয়া পৌরসভার করাইয়াঘোনা গ্রামের বশির আহমদের ছেলে বোরহান উদ্দিন, মৃত আকবর আহমদের ছেলে আনোয়ারুল ইসলাম পুতু, চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পালাকাটা গ্রামের বেলাল উদ্দিনের ছেলে ফাহিম ও আবদুল কাদেরের ছেলে রিদুয়ানুল ইসলাম লিটুর নাম উল্লেখসহ আরও ১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। তবে তারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন।
ভুক্তভোগী চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম দৈনিক আজাদীকে জানান, তাঁর ১০ একরের চিংড়ি প্রকল্পসহ আরও ৬টি ঘেরে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বুধবার দিবাগত রাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত এই তাণ্ডব ও লুটপাট চালায়। ঘেরগুলো দখলেও নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ১০ একর বিশিষ্ট এসব ঘেরের বৈধ মালিক হচ্ছেন কক্সবাজার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার চকরিয়ার কাকারার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা। এসব চিংড়ি প্রকল্প বৈধভাবে লিজপ্রাপ্ত হয়ে কয়েকজন চাষাকে লাগিয়ত দিয়ে চিংড়ি চাষ করে আসছিলেন।
চরণদ্বীপ এলাকার ঘের মালিক আজিজুল ইসলাম, আবুল কালামসহ বেশ কয়েকজন বৈধ চিংড়ি ঘের মালিক দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বর্তমানে যেসব ডাকাত–সন্ত্রাসী বাহিনী চিংড়ি জোনে তৎপর রয়েছে, তারা সবসময় সশস্ত্র অবস্থায় প্রস্তুত থাকে। এজন্য আইন–শৃক্সখলা বাহিনীর সদস্যরাও খুব একটা মুখোমুখি হতে চান না। আবার এদের সবসময় আশ্রয়–প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন শীর্ষ জনপ্রতিনিধিরা। মূলত প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিদের ইন্ধনেই এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গত দুইমাসে অন্তত ১০ হাজার একর চিংড়ি জমি দখলে নিয়েছে চাষি ও ঘের মালিক–কর্মচারীদের পিটিয়ে।’
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন শান্ত দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘নিজেদের অভিভাবক দাবি করা জনপ্রতিধিরাই এসব চিংড়ি ঘের দখল–বেদখল ও ডাকাতিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছেন। যেখানে আমার নিজেরও চিংড়ি প্রকল্পও ডাকাতি করা হয়েছে। দখলে নেওয়া হয়েছে রামপুর, চরণদ্বীপ, সওদাগরঘোনা মৌজার অন্তত ১০ হাজার একর জমির চিংড়ি ঘের।’
চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘দুর্গম এলাকায় এসব চিংড়ি ঘেরের অবস্থান। তাই তাৎক্ষণিক সেখানে গিয়ে অভিযান চালানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।’
তিনি বলেন, ‘চিংড়ি জোনের চরণদ্বীপ মৌজায় ১০ একর বিশিষ্ট সাতটি চিংড়ি ঘেরে তাণ্ডব ও লুটপাটের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্ত করে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কারা নতুন করে চকরিয়ার চিংড়ি জোনে অপরাধ সংঘটন করছে, তাদের ব্যাপারে সবিস্তারে খোঁজ–খবর নেওয়া হচ্ছে। অচিরেই সেখানে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে।’