একটানা অতি ভারি বর্ষণ, সেই সাথে মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পাহাড়ি ঢলের তোড়ে আক্ষরিক অর্থে চকরিয়ার সবকিছুই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এলজিইডি ও সওজের সড়ক, গ্রামীণ অবকাঠামো, চিংড়ি ঘের ও মৎস্য প্রকল্প, কৃষি ও ফসলি জমি, বেড়িবাঁধ, মানুষের ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে এমন কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই যেখানে ধ্বংসযজ্ঞ চলেনি।
উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া হিসাব বিবরণী অনুযায়ী, এবারের ভয়াবহ বন্যায় অন্তত হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। মূলত একাধিক কারণেই বন্যায় বার বার এসব ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে চকরিয়াবাসীকে। এবারের বন্যার পানি এবং তাণ্ডবচিত্র অতীতের সকল বন্যার রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এসবের প্রধানতম কারণ হচ্ছে তামাক চাষ। দ্বিতীয়ত পাহাড় ধ্বংস এবং তৃতীয়ত দ্রুত পানি ভাটির দিকে নেমে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছড়া খালগুলো বেদখল করে স্থাপনা নির্মাণ এবং নদীর নাব্যতা ব্যাপক হারে কমে যাওয়া। বন্যা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
অনেকেই রেললাইনের কারণে বন্যা হয়েছে দাবি করলেও এটি খুব বড় কারণ নয়। কারণ রেললাইনই যদি বন্যার কারণ হতো তাহলে ১০ হাজার ফুট উঁচুতে থাকা পার্বত্য লামা, আলীকদম শহর, বান্দরবান সদরে বন্যায় ডুবে থাকত না। তবে রেললাইন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বলা যায়। তবে সেটা নিয়ে সমীক্ষা হতে পারে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, কোনো গবেষণা বা প্রকল্পের পরিবেশগত সমীক্ষা রিপোর্ট না জেনে ঢালাওভাবে রেললাইনের কারণে ভয়াবহ বন্যা এটি কখনোই আমরা বলতে পারি না। আমরা হয়তো হাওড়ের বন্যার সঙ্গে এই রেললাইনের কারণটি নিছক মেলানোর চেষ্টা করছি। সেটি উচিত হবে না। তবে রেললাইনের ভুল থাকতে পারে, সেটি যাচাইয়ের জন্য সিভিল, মেকানিক্যাল, পানি বিশেষজ্ঞ নিয়ে তদন্ত করেই নির্ধারণ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, জুম চাষ, তামাক চাষ করে আমরা পাহাড় প্রতিনিয়ত উজাড় করে ফেলেছি। সংরক্ষিত বনে ইট ভাটা করে আমরা পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে এনেছি। এর ফলে একসঙ্গে অতীতের রেকর্ড ছাড়ানো বৃষ্টি হওয়ায় পাহাড়গুলো মুহূর্তেই ধসে পড়েছে। নদী দখল ও অপরিকল্পিত অবকাঠামো তৈরি করে প্রতিবন্ধকতার কারণে নদীর পানির প্রবাহ হারিয়েছে। এতে পানি উপচে লোকালয়ে ওঠে গেছে। এগুলোই বন্যার মূল কারণ। রেললাইন ইস্যু অনেক পরে। মাতামুহুরী পাড়ের লোকজন বন্যার জন্য প্রধানত তামাক চাষকেই দায়ী করেছেন। কারণ তামাক চাষ প্রতিবছরই চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। তামাক পোড়ানোর জন্য প্রয়োজন গাছ। যতই চাষ বাড়ছে ততই উজাড় হচ্ছে পাহাড়। কারণ যে হারে চাষ বাড়ছে সে হারে তো গাছ বড় হচ্ছে না। ফলে চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে গাছের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছরই নতুন নতুন বন উজাড় হচ্ছে। এটি পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনছে। শুধু তাই–ই নয়, চুল্লির জন্য গাছ না পেয়ে পাহাড়ের মাটি খুঁড়ে তুলে আনা হচ্ছে গাছের গোঁড়ালি পর্যন্ত। এই শিকড় তুলে ফেলায় বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই পাহাড় ধসে সরাসরি নদীতে পড়েছে। এতে কমে যাচ্ছে নাব্যতা।
ভুক্তভোগীরা বলেন, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়। পাহাড়ের মাটি ব্যবহৃত হচ্ছে সরকারি–বেসরকারি–ব্যক্তিগত প্রকল্পে। বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তোলা হচ্ছে বোল্ডার পাথর। আর সংরক্ষিত বনের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে ইট ভাটা। তারাও দেদারছে কাটছে পাহাড়। ফলে পাহাড়ের বৈশিষ্ট্য নষ্ট হচ্ছে। আর বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই পাহাড় ধসে পড়ছে নদীতে। কমে যাচ্ছে নদীর গভীরতা।
অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, পুরো মাতামুহুরীজুড়েই রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে ইচ্ছেমতো বালু তোলা হচ্ছে। এখন যেখানে বালু তোলা প্রয়োজন সেখানে না তুলে গাড়ি যেখানে সরাসরি নদীতে নামতে পারে ঠিক সেখানেই বালি তোলা হচ্ছে। ফলে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, গতিপথ পরিবর্তন হয়ে তীরও ভাঙছে। এভাবেই নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে।
মাতামুহুরী পাড়ে বেড়ে ওঠা ইবরাহীম মুহাম্মদ কলেজে অধ্যাপনা ও সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত আছেন দীর্ঘদিন। তিনি বলেন, তিনটি কারণের সঙ্গে আমি একমত, তবে তামাক চাষের পাশাপাশি বনখেকোরাও বন উজাড়ের জন্য দায়ী। গাছ বিনাশ, পাহাড় বিনাশ শেষে এখন নদীকেও বিনাশ করে চলেছি। এর বিপর্যয়ে এই বন্যা।
বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সরদার উদয় রায়হান বলেন, সাধারণত পুরো আগস্ট মাসে বান্দরবানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয় গড়ে ৪৪০ মিলিমিটার। কিন্তু গত ৪–৮ আগস্ট এই পাঁচদিনে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৮০০ মিলিমিটারের বেশি। অর্থাৎ একমাসের চেয়ে দ্বিগুণ বৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, লামা উপজেলায় মাতামুহুরী নদীর পানি গত ৫০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, মাতামুহুরী নদীকে যদি পরিকল্পিতভাবে শাসন ও নদীর দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা যায় তাহলে ভয়াবহ বন্যায় আর ভুগতে হবে না। অনেক আগেই বন্যায় ভয়াবহতার বিষয়টি মাথায় রেখে মাতামুহুরী নদীকে পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং করার জন্য পিজিবিলিটি স্টাডি করে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। তাছাড়া দেশের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকাও তাদের অর্থায়নে মাতামুহুরী নদী এবং ছড়াখালগুলোর পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে কিছু প্রস্তাবনা তৈরি করে তা নিয়েও কাজ করছে সরকার।