গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলতে যে ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামের মানুষের অধিকার ও শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতা বলতে একটি শক্তিকে বুঝায় যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার সিদ্ধান্তকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে পুরাতন ও আদি ব্যবস্থার নাম হলো সালিশ। সামাজিক প্রথাগুলোর সুস্পষ্ট প্রতিফলনের একটি হচ্ছে সালিশ। মানুষের সামাজিক জীবনে আচরণগত ভুলভ্রান্তি ও ব্যবহারের ফলে পারিবারিক সামাজিক ঝগড়া–বিবাদ বিবাহ–বিচ্ছেদ বৈধকরণ জমি–ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ আন্তঃকলহের সৃষ্টি হয়। এ আন্তঃকলহ নিরসনে যে মধ্যস্থতা অবলম্বন করে সমাধান করার উপায় হিসাবে সালিশের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ হয়েছে। সালিশ বলতে সমঝোতা বা মধ্যস্থতা। গ্রামীণ জীবন যাত্রায় দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিরোধ, সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা, আর্থিক লেনদেন মনোমালিন্য ইত্যাদি যাবতীয় অসহযোগিতা বিবাদ বিষোদগার মীমাংসা ও নিরসনের উপায় হলো সালিশ। সমাজে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত কোনো বিষয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ বা মতপার্থক্য সৃষ্টি হলে কিংবা সামাজিক অপরাধ সংঘাত সংঘর্ষ দেখা দিলে যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মীমাংসা বা সমাধান করা হয় তাকে সালিশ বলা হয়। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দু’ধরনের ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়, গ্রাম পর্যায়ে সালিশ, সমাজ প্রভৃতির মত অনানুষ্ঠানিক সংগঠন এবং ইউনিয়ন পরিষদ, মহল্লা কমিটি, মসজিদ কমিটি, বিদ্যালয় কমিটি বাজার কমিটি এসব আনুষ্ঠানিক সংগঠন। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উল্লিখিত উপাদান সমূহের মধ্যে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা প্রকাশের মুখ্য উপায়সমূহের মধ্যে গ্রামীণ সালিশ অন্যতম। সাধারণত গ্রামের প্রভাবশালী এবং বংশীয় নেতৃবর্গ সালিশ পরিচালনা বা নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। সালিশ যারা পরিচালনা করেন তারা গ্রামের প্রভাবশালী ধনী ভূসম্পত্তির মালিক মাতব্বর মহাজন বা সমাজে যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এমন ব্যক্তিরা গ্রামের অন্যান্য মানুষদের বিচার আচার করেন। বিচারে সাধারণত বিবাদির পক্ষে একটি সুনির্দিষ্ট রায়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। সালিশে দীর্ঘমেয়াদী শ্রেণি স্বার্থের কথা মনে রেখে উভয়পক্ষ আপোষরফায় পৌঁছাতে চেষ্টা করে। গ্রাম্য সালিশ বা বিচার যাই বলা হোক না কেন সকলের সামনে স্বচ্ছতার সাথে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়েই তার কর্মকাণ্ড এগিয়ে চলে।
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্ব অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত কোথাও সমাজ প্রধান, কোথাও সর্দার, কোথাও মাতব্বর, কোথাও প্রামাণিক মণ্ডল ইত্যাদি নামে পরিচিত। মাতব্বর শব্দটি পুরো গ্রাম বাংলার সমাজপতিদের প্রতিনিধিত্ব করে। সমাজ পরিবর্তনের এ পর্যায়ে এসে গ্রামীণ মাতব্বরদের ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। স্থানীয় সরকার কাঠামোর আওতায় আসায় এখন গ্রামগুলো ঐতিহ্যবাহী গ্রাম প্রশাসন কাঠামোকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ভেঙে পড়েছে গতানুগতিক প্রশাসনিক কাঠামো। গ্রামের মানুষ পুরানো ঐতিহ্য ছেড়ে নতুন মূল্যবোধ ও আচার আচরণ মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ইউনিয়ন পরিষদের গুরুত্ব বেড়েছে। গ্রামের বিচার আচার সমস্যা সমাধানের জন্য স্ব স্ব ইউনিয়ন পরিষদের শরণাপন্ন হচ্ছে। পূর্বের মতো গ্রামগুলো সহজ সরল ও শান্ত নেই। শহরের রুগ্ন সংস্কৃতির স্রোতধারা গ্রামীণ শান্ত জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আধুনিকতার নামে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম। এর সাথে সৃষ্টি হয়েছে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনগোষ্ঠী। যারা প্রচলিত গ্রামীণ কাঠামো বা গ্রাম পঞ্চায়েতকে মোটে ও পরওয়া করে না। বিপথগামী তরুণ প্রজন্মের মাধ্যমে নষ্ট হচ্ছে গ্রামের শান্তশিষ্ট পরিবেশ। বিভিন্ন মাদক জুয়া অসামাজিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন নেতৃত্ব। সুযোগ সন্ধানী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তল্পিবাহক চ্যুকার শ্রেণির একটি মহল পেশিশক্তি খাটিয়ে দখল করে নিচ্ছে গ্রামীণ ক্ষমতা। বিশেষ দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে গ্রামে সর্বত্র কায়েম করছে তাদের প্রভুত্ব। এসব দাপুটে নেতাদের সামনে জনগণ মুখ খুলতে সাহস করে না। ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলা পরিষদ ও থানা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো নিকটতম হওয়ায় মানুষ সে–সবের ধারস্থ হচ্ছে। এসব প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর ও দলীয় প্রভাব বিস্তার ও অযাচিত হস্তক্ষেপ করে ন্যায় বিচার প্রাপ্তি থেকে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে। গ্রামের সহজ সরল জীবন ব্যবস্থা দিন দিন একটা জটিল সমাজ ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাদকাসক্তি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, বেহায়াপনা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চুরি ডাকাতি প্রভৃতি অপকর্ম সংক্রামক ব্যাধিরমত গ্রামীণ সমাজে অনুপ্রবেশ করছে। এ সকল সমাজ বিরোধী কাজের প্রতিরোধ করা গতানুগতিক গ্রামীণ নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব নয়। গ্রামীণ সমাজ এক সময় রাজনীতিমুক্ত ছিল বিধায় সামাজিক কাঠামো দৃঢ় ও মজবুত ছিল। বর্তমান রাজনৈতিক প্রভাবে গ্রামীণ নেতৃত্ব শিথিল হয়ে পড়েছে। অসামাজিক কর্মকাণ্ডের কারণে যাদের ওপর সামাজিক বিধি নিষেধ আরোপিত ছিল কালের বিবর্তনে তারাই এখন নেতৃত্বের আসনে উপবিষ্ট। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
লেখক
প্রাবন্ধিক