বাংলাদেশ একটি গ্রাম প্রধান দেশ। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এই দেশে রয়েছে আটষট্টি হাজারেরও বেশি গ্রাম। গ্রাম বাংলার অপার সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ হই বারবার। গ্রাম আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। শিকড়ের সন্ধানে গ্রামেই আমরা বারবার ফিরে যাই। গ্রামে ছেলেবেলা কেটেছে এমন মানুষের কাছে গ্রাম বরাবরই দুর্নিবার এক আকর্ষণ। দেশের অধিকাংশ মানুষের সাথেই গ্রামের সম্পর্ক সুনিবিড়। তাদের শৈশব কৈশোর গ্রামে কাটলেও জীবন-জীবিকার টানে হয়তো সকলেই একসময় শহর বা নগর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। কিন্তু ফেলে আসা গ্রামের সেই স্মৃতি মানুষকে চিরকালই নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে। ছোটবেলায় যখন আমরা কবিতায় পড়তাম ‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন,মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন’ কিংবা ‘পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই, একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই’ সেই বিমুগ্ধতা কিন্তু আমাদের হৃদয়কে এখনও স্পর্শ করে। আমাদের দেশটা হচ্ছে কৃষি নির্ভর অর্থনীতির একটা দেশ। সেই কৃষি আবর্তিত হয় এই গ্রামকে ঘিরে। পৃথিবীর অনেক দেশের অর্থনীতি হচ্ছে শিল্প নির্ভর অর্থনীতি। তাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন শিল্পকে ঘিরে এবং তা নগর কেন্দ্রিক। কিন্তু বাংলাদেশের মত উর্বর পলিমাটির এদেশ হচ্ছে কৃষি নির্ভর অর্থনীতির একটি দেশ। গ্রামকে আমরা বলি কৃষির সূতিকাগার। উৎসব পার্বনে গ্রামের সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলো গ্রামে গিয়ে উৎসব পালন না করলে সে মানুষের কাছে উৎসব যেনো আনন্দ মুখর হয় না বা পরিপূর্ণতা লাভ করে না। গ্রামের রয়েছে চিরায়ত ঐতিহ্য। বাঙালির গ্রামের চিরায়ত সেই ঐতিহ্য বাঙালির ঐতিহ্য সংস্কৃতিরই অংশ। জীবনের শৈশব-কৈশোর কাটানো গ্রাম জীবন স্মৃতির পরতে পরতে দোলা দিয়ে যায় প্রতিনিয়ত। সেই উন্মুক্ত খোলা মাঠ, সবুজ ধান ক্ষেতের হাতছানি, সোনালি পাকা ধানের দোল খাওয়া, নদী, মেঠোপথ, নানান গ্রামীণ খেলাধুলায় মুখরিত মাঠ, নদী, বালুচর, যাত্রা,পালা গান, পুকুর নদীতে দুরন্ত ঝাপাঝাপি বলুনতো আর কোথায় মেলে? এ যেনো মুক্তপাখির অবাধ বিচরণ। কবি শামসুর রাহমান তাঁর ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতাকে কল্পনা করেছিলেন,‘স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্য পুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।’ আসলে সত্যিই তো গ্রাম যেনো নগরের যান্ত্রিকতার কোলাহল ছেড়ে মুক্ত হাওয়াতে অবগাহন হওয়ার একদণ্ড প্রশান্তি। কিন্তু গ্রামের সেই রূপ বৈচিত্রের পাশাপাশি ঐতিহ্যের অংশগুলোও ক্রমশ যেনো হারিয়ে যেতে বসেছে। নাগরিক সুবিধা পাওয়ার জন্য সামান্য অর্থবিত্ত হলেই মানুষ ছুটছে শহরের দিকে। গ্রাম হয়ে পড়ছে ক্রমশ দুর্বল অর্থবিত্তহীন মানুষের আশ্রয়স্থল। সেখানে সহজে মেলে না এখন সেই ঐতিহ্যের নানামুখী দিকগুলো। যান্ত্রিকতা ও প্রযুক্তি গ্রামকেও আচ্ছন্ন করেছে প্রবলভাবে। প্রযুক্তিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু গ্রামের অর্থনীতি ও ঐতিহ্য সুদৃঢ় করতে না পারলে তা আমাদের নগরায়নে চাপ পড়বে এবং নাগরিক জীবনে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাবই ফেলবে। গ্রামে নাগরিক সুযোগ সুবিধাগুলো ধীরে ধীরে আরো জোরদারভাবে প্রসারিত করতে হবে। একসময় এদেশের পুরো সমাজ ব্যবস্থা ছিলো গ্রাম ভিত্তিক। মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মানুষ সমাজবদ্ধ যেখানে বসবাস করতে শিখেছে সেখানেই ধীরে গ্রাম ও সমাজ ব্যবস্থার উৎপত্তি ঘটেছে। এই গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা থেকেই ধীরে ধীরে শহর ও নগরায়ন। সেই আদিকাল থেকেই গ্রামীণ অর্থনীতি ছিলো কৃষিনির্ভর। সেই নির্ভরতা এখনো প্রচণ্ডভাবে বিদ্যমান। নাগরিক প্রয়োজনে অনেক কিছুই আমরা এখনো গ্রামের ওপর নির্ভরশীল। সেই প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় রাজস্ব আহরণের উৎস ছিলো কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি। জমিদার প্রথা বা মহাজন প্রথা ছিলো গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় একধরনের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। গ্রামে কৃষিজীবির সাথে বসবাস করা মানুষের সাথে কামার, কুমার, মাঝি, জেলে, তাঁতী নিম্নবত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির বসবাস সেই আদিকাল থেকেই। গ্রামীণ জনপদে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এই আধুনিকতার যে ছোঁয়া, তার অবশ্যই ইতিবাচক দিক আছে। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন মানে নগর শহর গ্রামেরই উন্নয়ন। যে গ্রামের অর্থনীতি আমাদের নগর জীবনের মানুষের প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ, সেই গ্রামের অবকাঠামোর ভিতকে শক্তিশালী করা জরুরি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটির মত, যার দুই-তৃতীয়াংশ লোক বাস করে এই গ্রামীণ জনপদে। তবে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে গ্রামীণ জনপদ থেকে ছুটে আসে মানুষ শহরের যান্ত্রিক জীবনে। এটা তার পেশাগত বা জীবন যাপনের তাগিদে। কিন্তু এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, খাদ্যের চাহিদা নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মত কাজে এবং শহর-নগর জীবনের বিভিন্নমুখী চাহিদা মেটাতে গ্রামের নিপীড়িত সাধারণ মানুষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু সে মানুষগুলো সবসময় দৃৃশ্যপটের আড়ালেই থেকে যান। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের মানুষগুলোর দুরাবস্থার পেছনে অনেক কারণ বিদ্যমান আছে। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার প্রভাবে গ্রামের সেই মানুষগুলোর অনেকেই আবার শহরমুখী। পোশাক শিল্পের ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে গ্রামের সাধারণ মানুষ সস্তা দামে নিজেদের শ্রমকে বিক্রি করে দিচ্ছে গার্মেন্টস শিল্পে। শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে গ্রামের কুটির শিল্প বিলুপ্ত প্রায়। শুধু আড়ালই নয়, অমানবিক শোষণ নিপীড়ন ও বঞ্চিত হবার উদাহরণও অনেক। গ্রামের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী মধ্যস্বত্ত্ব ভোগীদের হাতে পড়ে গ্রামের কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত সংবাদও কম নয়। মাঝখানে শহর বা নগরে বসবাসকারীরা তার সুবিধাভোগী হয়ে থাকেন। যে কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা হচ্ছে গ্রামকেন্দ্রিক উন্নয়নে স্থবিরতা। গ্রামকে দূরে রেখে বা আড়ালে রেখে অগ্রগতির যে চিত্র আমরা দেখি সেটা হয়তো মুষ্টিমেয় কিছু চিহ্নিত জায়গা মাত্র। এ ব্যবস্থা সে অতীত কাল থেকেই চলে আসছে। ব্রিটিশ আমলে থেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ নানা ধরনের বন্দোবস্তের বিষয়গুলো ছিল কৃষকদের শোষণের হাতিয়ার। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কৃষকরা রাজস্ব পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তাদের কৃষকদের গ্রামীণ কৃষকদের জীবনে নেমে আসতো নানা ধরনের নিপীড়ন। এখন হয়তো তার রূপ ও ধরন পাল্টেছে। কিন্তু শোষণ প্রক্রিয়াটা নানারূপে বিদ্যমান রয়েছে।
বর্তমান গ্রামীণ জীবনে কৃষকরা আজও নানা বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারে নি। নিজ হাতে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে তারা বঞ্চিত হন প্রায় সময়ই। ফলে কঠোর পরিশ্রম করা কৃষকদের ভাগ্যের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটে নি। শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সুবিধা থেকে এই নিপীড়িত মানুষের অনেকেই সুবিধা বঞ্চিত। অথচ তাদের শ্রমেই গড়া এই আধুনিক নাগরিক সমাজ। গ্রামের সেই চিরচেনা পথে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। নাগরিক সুবিধাগুলো ধীরে ধীরে গ্রামেও সম্প্রসারিত হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎসহ নানা সুযোগ সুবিধা পৌঁছে যাচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালেই দেখি সেখানে প্রতিটি গ্রামকেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদনসহ সব সুযোগ-সুবিধায় তৈরি করা হয়েছে। আমাদের দেশের গ্রামগুলোও উন্নত বিশ্বের ন্যায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। তবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এই আধুনিকীকরণে আমাদের মনে রাখতে হবে গ্রামের সেই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর কথাও। মনে রাখতে হবে আমাদের গ্রামের চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথা। সেই ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করেই গ্রামীণ জনপদের উন্নয়ন ঘটাতে। উন্নয়নের স্রোতে যেনো গ্রামীণ ঐতিহ্যের অপমৃত্যু না ঘটে। গ্রামীণ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আমাদের অস্তিত্বের শিকড়। আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ভিন্ন এক বৈচিত্র আছে, যেটা পৃথিবীর অন্য দেশে মেলে না। সংরক্ষণ করতে হবে গ্রামের সেই ঐতিহ্যগুলোকে। গ্রামে নাগরিক সুবিধার প্রসারণ করতে হবে গ্রামের ঐতিহকে ধারণ করেই। নগরায়নের নামে গ্রাম যেনো তার চিরায়ত লোকজ ঐতিহ্য হারিয়ে না ফেলে। কারণ গ্রামেই মেলে আমাদের শিকড়ের সন্ধান। গ্রামীণ উন্নয়নের বাজেটে আমাদের ঐতিহ্য,সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। গ্রামে গড়ে উঠুক নাগরিক সুবিধা, শোষণ থেকে মুক্তিপাক সাধারণ নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকগুলো, তার সাথে বেঁচে থাকুক আমাদের হাজার বছরের লোকজ সংস্কৃতি।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি ডিগ্রি কলেজ