ষড়ঋতুর দেশ বলেই আমাদের দেশের প্রকৃতিতে থরে বিথরে গাঁথা আছে রঙের বর্ণিল বিচিত্রতা ও সৌন্দর্য। তাই আমাদের দেশে প্রতিটা ঋতুই তার সাথে করে নিয়ে আসে ভিন্ন ভিন্ন উৎস ও রঙের ধারা। তেমনি শরৎ বিদায়ী প্রকৃতিতে হেমন্ত নেমে আসে হালকা কুয়াশায় দূর্বাঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশিরের মুক্তা ঝরিয়ে শীতের বার্তা নিয়ে। বাতাসে মিশে থাকে শীত শীত গন্ধ। দিগন্তব্যাপী সর্ষের কচি সবুজ চারার বুক হলুদ ফুলে ছেয়ে যায়। হেমন্তের মাঝামাঝিতেই সর্ষের মাঠ হলদে গালিচায় রূপান্তরিত হয়ে ওঠে। আমন ধানের সবুজ ক্ষেতেও সাদা সবুজের মিশেলে আউশ ও আমন ধানের শিষ দুলে হেমন্তের সুগন্ধি বাতাসে। সুস্বাদু বিভিন্ন শাকসবজির চাষও হয় হেমন্তকালের শুরুতেই।
বনফড়িংয়ের উড়াউড়ি আর মৌমাছিরা দলবেঁধে উড়ে বন বনান্তে। ফুলের বুকে মুখ গুঁজে মধুর খোঁজে চঞ্চলতায় ঘুরে ঘুরে ভ্রমরের ঝাঁক অস্থির হয় মাদকীয় উন্মাদনায়। শীমফুলের বুকে বিন্দু বিন্দু শিশিরে হেমন্তই যেন শীত ও বসন্তের আগাম কবিতা রচনা করতে থাকে। গাছের পাতা ধুলো ধোঁয়াশায় হলদেটে মলিনতায় পতনের সুর সাধে। হেমন্তেই প্রকৃতি আচমকাই তার রঙ বদল করে। হেমন্তের শেষে নরম রোদেও গাছের সবুজ পাতাগুলো হলদেটে হতে হতে একসময় শুকিয়ে ঝরে যায়। হৈমন্তী বাতাসে ঝরাপাতারা ব্যথার মর্মর সিম্ফনিতে কাঁদে। বৃক্ষদেবীও তার কঙ্কালসাড় শরীর ভোরের কুয়াশায় ভিজিয়ে শুদ্ধ স্নান সেরে আশান্বিত দৃষ্টি নিয়ে সম্মুখে তাকিয়ে থাকে নগ্ন দেহে পুনরায় কচিপাতার সবুজ আভরণের প্রত্যাশায়। সবুজ আমন ধানের মাঠ সোনালি রূপ ধারণ করে মৌ মৌ সুঘ্রাণে। হলুদ সর্ষের মাঠ সবুজ হয়ে যায় পুষ্ট পোয়াতি বীজে। শীতের সবজিতে সবুজ আর সবুজ দেখায় মাঠের পর মাঠ।
হেমন্তেই নতুন রূপে সেজে উঠে বাংলার মাঠঘাট ক্ষেত খামারসহ কৃষাণির উঠোন। নবান্নের রঙে কৃষকের চোখ দুটো সুখের স্বপ্ন আঁকে। কৃষাণী বধূরও ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহুগুণ। কৃষাণী কাদামাটিতে উঠোন ও উনুন লেপে টনটনে করে তুলে। কাঠা, কুলা আর পাতলাগুলোও কাঁচা গাবের রসে কুরো মিশিয়ে লেপে মুছে শুকিয়ে সব নতুন করে রাখে। কারণ, অগ্রহায়ণের শেষের দিকেই সর্ষের বীজ শুকিয়ে তামাটে রঙে উঠে আসে কৃষাণীর উঠোনে। ধান কাটার সাথেই শুরু হয়ে যায় নবান্নের আমেজ। ধান আর সর্ষে শুকিয়ে ঘরে তুলতে এসব সামগ্রীর খুব প্রয়োজন হয়। পৌষের শুরুতেই ‘নবান্ন’ যা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। গাঁয়ের বউঝিরাও তখন বাপভাইয়ের বাড়ি নাইয়র যায়। ঘরে ঘরে মুড়ি মুড়কি, পিঠাপুলি আর কালোজিরা কিংবা বিন্নি চালের পায়েশ, ফিরনি ও পোলাওয়ের আয়োজনে চলে নবান্ন উৎসব।