গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে তৎপর হতে হবে

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:০০ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের অন্যান্য বদ্বীপ অঞ্চলকে বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের মত ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক গঠনে গড়ে উঠা বদ্বীপে বিপুল গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ার কথা। আন্তর্জাতিক গ্যাস জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়নেও এর স্বীকৃতি রয়েছে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রর ইউএসজিএস পেট্রোবাংলার সাথে যৌথ জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদের গড় পরিমান ন্যূনতম ৩২ টিসিএফ। একই সময় নরওয়ের জাতীয় তেল গ্যাস কোম্পানি এনডিপি বাংলাদেশের সরকারি এজেন্সির সঙ্গে সম্পাদিত জরিপে দেখায় যে, দেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদের গড় পরিমান ৪২ টিসিএফ। অন্যদিকে ২০১৮ সালে ডেনমার্কের গ্যাস পরামর্শক র‌্যামবোল তাদের জরিপে দেখায় যে, এর পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। যা দিয়ে কমপক্ষে দেশের ৪০-৫০ বছরের জ্বালানি চাহিদা মিটানো সম্ভব। ২০০০ হতে ২০২০ পর্যন্ত ২০ বছরে বাংলাদেশ ব্যবহার করে প্রায় ১৩ টিসিএফ গ্যাস। এই সময়ে দেশে আবিষ্কৃত হয়েছে মাত্র ২ টিসিএফ গ্যাস। অনুসন্ধান কুপ খননের সংখ্যাও অত্যন্ত কম। ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সাথে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে সমুদ্রসীমা অর্জন করা গেলেও সমুদ্রের গ্যাস ব্লকগুলোতে অনুসন্ধান কার্য্যক্রম শুরু করা হয়নি। এর বিপরীতে এলএনজিকে ভবিষ্যৎ জ্বালানি হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে এগিয়েছে দেশ। এলএনজি আমদানির জন্য দুটি সামুদ্রিক টার্মিনাল ও প্রতিদিন ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহে সক্ষমতা তৈরির জন্য পাইপলাইন ও অব কাঠামো প্রস্তুত করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশে গ্যাস ব্লকের মধ্যে সাগরে ২৬টি ও স্থল এলাকায় ২৩টি। তবে দুইটি ব্লক স্থল ও সাগরে রয়েছে বলে মোট ব্লক ৪৭টি। বঙ্গোপসাগরের ২৬টি ব্লকের মধ্যে ১৫টি গভীর সমুদ্রে ও ১১টি অগভীর সমুদ্রে। যার মধ্যে ২ টিতে অনুসন্ধান কাজ করছে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ও এনজিসি ভিদেশ লিমিটেড। তারা জরিপ শেষ করলেও এখনো কূপ খনন করতে পারেনি। বাকী ২৪টিতে এখনো জরিপ করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দরপত্র ও পুনঃ দরপত্রের নামে সময় ক্ষেপণ করে জরিপের উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করে এলএনজি আমদানির পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। সাগরে তেল, গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে টানতে দরকার ব্লকগুলোর প্রাথমিক তথ্য। বহুমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে সেই তথ্য পাওয়া যায়। ২০১৫ সালে এই প্রক্রিয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়া হলেও এখনো ভূকম্পন জরিপ শুরু হয়নি। অথচ ২০১৩ সালে সমুদ্রে জরিপ চালিয়ে তথ্য নিয়েছে মায়ানমার। অপরদিকে মিয়ানমার ও ভারত ইতিমধ্যে সাগরে অনুসন্ধান করে গ্যাস পেয়েছে।
তবে জ্বালানি বিভাগ নিজেরা জাহাজ কিনে জরিপ করার জন্য ১৬০০ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব তৈরি করেছিলো। যদিও পরে এটি বাতিল করা হয়। ২০১৪ সালে সাগরে বহুমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ পরিচালনার পরিকল্পনা নেয় পেট্রোবাংলা। পরের বছর ২০১৫ সালে দরপত্র আহবান করে। পরে ২০১৬ সালে পুনরায় দরপত্র আহবান করে। এতে নরওয়ের টিজিএস ও যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ফ্রান্সের কোম্পানি স্লাম বে জ্যে এর কনসোর্টিয়াম কাজটি পায়। গত মার্চ’ ২২ এ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী তারা নিজস্ব অর্থায়নে জরিপ কাজ সম্পন্ন করবে। পরবর্তীতে তারা আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস কোম্পানির কাছে জরিপের তথ্য বিক্রি করে তাদের বিনিয়োগের টাকা তুলে নিবে। চুক্তি অনুসারে ১ বছরের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা জমা দেওয়ার কথা ছিলো ও পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে জরিপ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মার্চেই তারা বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা জমা দিয়েছে। সমুদ্রের প্রায় ৮০% এলাকায় দ্বিমাত্রিক জরিপ চালানোর কথা তাদের।
আগেই বলেছি সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এলএনজি আমদানি করেছে অথচ কিছু টাকা খরচ করে পাইপলাইন না করায় ভোলায় আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রের সক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাস উত্তোলন করে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ১৯৯৫ সালে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে দেশীয় সংস্থা বাপেঙ। যাতে দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ১৫ কোটি ঘনফুট হলেও বর্তমানে ব্যবহার করা হচ্ছে ৬ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের উৎপাদন বাড়তে আরো দুটি কুপ খননের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় ৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করার পরিকল্পনা নিয়েছে বাপেঙ। ২০১৮ সালে বাপেঙ আরেকটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে ভোলা ২য় নর্থ। শাহবাজপুর থেকে ২০০৯ সালে গ্যাস উৎপাদন শুরু হলেও ভোলা নর্থ থেকে এখনো গ্যাস উৎপাদন করা হয়নি। এই দুইটি গ্যাস ক্ষেত্রে ১.৫ টিসিএফ গ্যাসের মজুূদ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে চাহিদা না থাকায় ভোলার গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে না।
পেট্রোবাংলা সুত্র বলছে, ভোলায় গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের পর নব্বইয়ের দশকে ঐ গ্যাস বাইরের জেলায় আনার প্রস্তাব দিয়েছিলো বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিকল। তারা ১২০ কিলোমিটার পাইপলাইন করার প্রস্তাব করেছিলো। এ গ্যাস ব্যবহার করে ভোলা বরিশাল ও খুলনায় বিদ্যুতকেন্দ্র করার প্রস্তাবও দিয়েছিলো। কিন্তু সরকার এতে রাজি হয়নি। এটি লাভজনক হবে না বলে ধারণা ছিলো সরকারের। তবে বর্তমানে ভোলা নর্থ গ্যাস ক্ষেত্রের দুটি কুপ খননের কাজ দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার কোম্পানি গাজপ্রমকে। ইতিমধ্যে একটি কুপ খনন শুরু করেছে তারা। আর গ্যাস বাইরে আনার পাইপলাইন নির্মাণে নতুন করে আলোচনা শুরু করেছে মার্কিন কোম্পানি একসিলারেট এনার্জির সাথে। একটি লাইন ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা যাবে। আরেকটি যাবে বরিশাল থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। বাংলাদেশের প্রায় সব বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র যথেষ্ট পুরানো হয়ে পড়ায় সেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সাধারণভাবে একটি গ্যাস ক্ষেত্রের স্বাভাবিক জীবনে প্রাথমিক অবস্থায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে একপর্যায়ে উৎপাদন চুড়ায় পৌছে এবং তারপর থেকে উৎপাদন কমে একসময় জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ‘ওয়াটার আউট’ হয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। যেমন ২০১৬ সালে দেশের বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র তিতাসের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ অবস্থায় ছিলো দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট, বর্তমানে তা ৪১ কোটি ঘনফুট। একইভাবে উৎপাদন কমছে হবিগঞ্জ, কৈলাসটিলা, বাখরাবাদ ও রশিদপুরে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২০টি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এরমধ্যে শেভরনের বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন ১২০ কোটি ঘনফুট। গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে। যা দেশে দৈনিক গ্যাস উৎপাদনের ৫১%। তবে এটি আর কতদিন সার্ভিস দিতে পারবে সেটি বড় প্রশ্ন। তাই সর্বশক্তি দিয়ে দিয়ে গ্যাস উৎপাদনের লক্ষ্যে নতুন নতুন কুপ খনন করা দরকার। কারণ ভূতাত্ত্বিক বিবেচনায় বদ্বীপ গঠিত এই দেশটির গ্যাস সম্ভাবনাকে অতি উজ্জ্বল বলে বিজ্ঞানীরা মত দিয়েছেন। যার প্রমাণ মেলে ২০১২ সালে সমুদ্র সীমা নিষ্পত্তির পর মায়ানমার তার সমুদ্র এলাকায় জোরালো অনুসন্ধানের মাধ্যমে বড় আকারের গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ তার সমুদ্র সীমায় সে তুলনায় অনুসন্ধান করেনি বললেই চলে। সে কারণেই দেশে এই গ্যাস সংকট। বিশ্বব্যাপি গ্যাস তেল অনুসন্ধান কার্যকলাপের বিবেচনায় বাংলাদেশ ন্যূনতম অনুসন্ধানকৃত এলাকা হিসাবে বিবেচিত। তাই বাংলাদেশকে অনতিবিলম্বে গ্যাস অনুসন্ধানে দেশব্যাপী জোরালো কার্যক্রম গ্রহণ করে নিজস্ব গ্যাস তুলতে হবে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় অতিদ্রুত ত্রিমাত্রিক জরিপের ভিত্তিতে খনন কাজ শুরু করতে হবে। কারণ সীমান্তবর্তী এলাকায় পার্শ্ববর্তী দেশ আগে গ্যাস উত্তোলন শুরু করলে পরে আমাদের আর গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। মনে রাখতে হবে, গ্যাস সরবরাহের সমস্যাকে একটি টেকসই সমাধান দিতে হলে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করাই সঠিক উপায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশু রাসেলের প্রতি বাবার ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে বৃষ্টির শংকা