সিয়ামের বয়স চৌদ্দ। পড়াশোনার ফাঁকে সবসময়ই তার মন টানে প্রকৃতি, অভিযান আর রহস্যের প্রতি। এক ছুটিতে বাবা–মায়ের সঙ্গে সে বেড়াতে এসেছিল পাহাড়ি গ্রামে। দিনের বেলায় ঝর্ণাধারার শব্দ, পাখির ডাক, আর চারদিকে সবুজে ঘেরা সেই অচেনা প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ছিল সে।
কিন্তু বিকেলের দিকে হঠাৎই আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেলো। কালো মেঘে ঢেকে গেলো আকাশ, তারপর শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়–বৃষ্টি। সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটলো। কিন্তু ভিজে যাওয়া আঁকাবাঁকা পথ, ঝর্ণার কাছে কাদা আর অদ্ভুত গর্জন এই বিশৃঙ্খলার মাঝেই সিয়াম দলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
চারপাশে তখন ঘন অন্ধকার, মাঝে মাঝে বজ্রের ঝলকানি। ভয় আর একাকীত্বে বুক ধড়ফড় করছিলো তার। ঠিক তখনই সে দেখতে পেলো পাহাড়ের পাথুরে দেয়ালে এক ফাঁকা অংশ যেন একটা গুহার মুখ। কৌতূহল আর আত্মরক্ষার তাগিদে সিয়াম দৌড়ে ঢুকে গেলো ভেতরে।
তবে গুহাটা পুরোপুরি নির্জন নয়। হঠাৎই সে শুনতে পেল টুপ টাপ শব্দ, যেন কোথাও পানি পড়ছে। সেই সঙ্গে অদ্ভুত এক গুঙিয়ে ওঠার আওয়াজও মিললো। তুহিনের শরীরে কাঁটা দিলো! এ কি কোনো বন্য প্রাণী? ভাগ্যিস তার হাতে একটি টর্চলাইট ছিলো। ধীরে ধীরে সাহস করে টর্চটা জ্বালাতেই দেখলো, দেখতে ছাগলের মতো কী যেনো এক তাকে দেখে পালাচ্ছে। তুহিন কিছুটা ভয় পেলেও অজানা এক সাহস নিয়ে এগুতে লাগলো ছাগলটির পিছে পিছে। ছাগলটি ছুটছে তো ছুটছে।
বাইরে তখনও ঝড় চলছে বজ্রপাতের আলোয় গুহার দেয়াল কখনও ভৌতিক, কখনও রহস্যময় মনে হচ্ছিল। ক্ষুধা, ভেজা শরীর আর ক্লান্তি সত্ত্বেও ভেতরে এক নতুন দৃঢ়তা তৈরি হলো সে একা, কিন্তু একেবারেই অসহায় নয়।
সিয়াম ঝড়ের রাতে গুহায় ঢুকেছিল কেবল আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু ভেতরে ঢুকে সে বুঝল এটা কোনো সাধারণ গুহা নয়। শ্যাওলায় ঢাকা দেয়ালে খোদাই করা অদ্ভুত চিহ্ন, অর্ধেক ভাঙা মূর্তি, আর মাটির ভেতর অচেনা কিছু পাত্র সবকিছু যেন অতীতের কোনো অজানা সভ্যতার নীরব সাক্ষী।
টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ সে আবিষ্কার করল দেয়ালের গায়ে খোদাই করা এক মানচিত্রের মতো কিছু। কাছ থেকে ভালো করে দেখতেই চমকে উঠল চিহ্নগুলোর মাঝে সূর্য, পাহাড় আর একটি নদীর রেখা আঁকা আছে। নিচে অদ্ভুত কিছু অক্ষর, যা সে বুঝতে পারলো না। কিন্তু পুরোটা যেন কোনো গুপ্ত নির্দেশ বা ধাঁধা।
ঠিক তখনই আবার সেই গুঙিয়ে ওঠার শব্দ। ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে দেখে একটি পাহাড়ি ছাগল আহত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রাণীটিকে সামলে নেওয়ার পর সিয়াম আবার মানচিত্রটার কাছে ফিরলো। তার মনে হলো এটা হয়তো কোনো গুপ্তধনের পথ।
রাত যত গভীর হচ্ছিল, তুহিনের ভেতরে ভয় কমে গিয়ে কৌতূহল বাড়ছিল। গুহার বাতাসে প্রতিধ্বনিত শব্দগুলো যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠছিল। হঠাৎ দেয়ালের এক পাশে টর্চের আলো পড়তেই চকচক করে উঠলো কিছু ধাতব জিনিস। গিয়ে দেখে পাথরের নিচে লুকানো আছে এক ছোট্ট পিতলের বাক্স, যার গায়ে একই রকম অদ্ভুত খোদাই করা চিহ্ন।
সিয়াম বাক্সটা তুলতে গেলেও সেটি ভারী। খোলা যাচ্ছিল না। তবুও সে বুঝল এখানে নিশ্চয় কিছু মূল্যবান জিনিস লুকানো আছে। হয়তো সোনা, রূপা, কিংবা আরও অমূল্য কিছু। কিন্তু রাতের আঁধারে একা এক কিশোর আর আহত এক ছাগল তার পক্ষে বাক্স খোলা সম্ভব নয়। তবে সে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্রও নয়।
ব্যাগে আছে টর্চ, খাবার, দড়ি, হাতবন্দি, ম্যাপ এবং তার অদম্য সাহস। তুহিন মানচিত্রের চিহ্ন অনুযায়ী এগোতে থাকে। পথে আসে নানা বাধা সঙ্কীর্ণ চটকদার পথ, হঠাৎ করে ধস নেমে আসা মাটি, এবং অদ্ভুত প্রতিধ্বনি। গভীর অন্ধকারে হঠাৎ আবিষ্কার করে এক প্রাচীন গুপ্তকক্ষ। দেয়ালে আরও খোদাই, কিছু অদ্ভুত প্রতীক, আর মাটিতে পাথরের একটি স্তূপ, যার নিচে আছে সেই পিতলের বাক্স।
সিয়াম ধীরে ধীরে বাক্সটি খুলতে থাকে। ভেতরে আছে প্রাচীন স্বর্ণ–মুদ্রা, আভরণ এবং একটি পুরোনো চিঠি। চিঠিতে লেখা আছে ‘এই ধনটি কেবল সেই মানুষের জন্য, যার হৃদয়ে আছে সাহস, বুদ্ধি ও সহানুভূতি।’
চোখে জল, মনে আনন্দ সিয়াম বুঝতে পারে, গুপ্তধনের চেয়ে বড় মূল্য হলো সাহস এবং দয়া।
সেদিন থেকে তুহিনের জীবন হয়ে ওঠে নতুন রোমাঞ্চের অধ্যায়। গুহার সেই রাত, প্রাচীন গুপ্তধন, একলা এক সাহসিক অভিযান সবই তার জীবনের সবচেয়ে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। আর গুহার অন্ধকারে যেটা সে শিখেছিল ভয়কে জয় করতে হলে প্রয়োজন শুধু সাহস, বুদ্ধি, এবং হৃদয়ের সঠিক দিকনির্দেশ।









