যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা সম্পূরক শুল্কের পরিমাণ আলোচনার মধ্য দিয়ে কমিয়ে আনতে পারাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে অভিনন্দন জানিয়ে গতকাল শুক্রবার এক বার্তায় তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের শুল্ক আলোচক দলকে আমরা গর্বের সঙ্গে অভিনন্দন জানাই, যা এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর চড়া হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে। এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে গত ৭ জুলাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের ওপর সম্পূরক শুল্কের হার হবে ৩৫ শতাংশ, যা কার্যকর হবে ১ আগস্ট। খবর বিডিনিউজের।
প্রতিনিধিদলের প্রশংসা করে প্রধান উপদেষ্টা তার বার্তায় বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা এবং আরো এগিয়ে নিতে আমাদের আলোচকরা অসাধারণ কৌশলী দক্ষতা এবং অটল প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছেন।
ইউনূস বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তারা নিরলস পরিশ্রম করে এই জটিল আলোচনা চালিয়ে এসেছেন, যার মধ্যে ছিল শুল্ক, অশুল্ক বাধা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক নানা চ্যালেঞ্জ। এই চুক্তি বাংলাদেশের তুলনামূলক বাণিজ্যিক সুবিধা বজায় রেখেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তা বাজারে প্রবেশাধিকার আরও সম্প্রসারিত করেছে এবং দেশের মৌলিক স্বার্থ সুরক্ষিত করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই অর্জন কেবল বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধির সাক্ষ্যই দেয় না, বরং এটি বৃহত্তর সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে দ্রুততর প্রবৃদ্ধি ও টেকসই সমৃদ্ধির পথ তৈরি হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল, আজকের সাফল্যই তা প্রমাণ করে। এ অর্জন জাতির দৃঢ়তা এবং একটি শক্তিশালী অর্থনীতির ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের সাহসী দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিচ্ছবি।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৭০টি দেশের পণ্যে সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত নতুন শুল্কহার ঘোষণা করেছেন। ১ আগস্টের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করার যে সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল, তার ঠিক আগ মুহূর্তে এই ঘোষণা এসেছে।
এই চুক্তিগুলো শুধু শুল্ক সমন্বয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেসব দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে, সেসব ক্ষেত্রেও সংস্কার আনতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা ও বৃহত্তর অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আলোচনার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য কিনতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক, যেন বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যায়।
বিষয়টির পরিধি অনেক বিস্তৃত হওয়ায় এ আলোচনার প্রক্রিয়া ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। কেবল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক কমালেই সেখানে রপ্তানি করা পণ্যে শুল্ক ছাড় মেলেনি। বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো দেশের ওপর শুল্কহার কত হবে, তা নির্ধারিত হবে এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুতির গভীরতার ভিত্তিতে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা প্রতিদ্বন্দ্বী পোশাক রপ্তানিকারক দেশ শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার প্রায় সমান, যাদের শুল্কহার ১৯ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। এর ফলে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার কোনো ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় ভারতকে ২৫ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়তে হয়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ এবং সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলোচনা করেছি। আমাদের পোশাক শিল্পকে রক্ষা করা ছিল প্রধান অগ্রাধিকার। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য কেনার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আমরা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মার্কিন কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কও বজায় রাখছি।
তিনি বলেন, আজ আমরা সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এড়াতে পেরেছি। এটা আমাদের পোশাক শিল্প এবং এই খাতের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য সুখবর। একই সঙ্গে আমরা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছি এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তা বাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি করেছি।