গুমাইবিলে ধান কাটা শুরু

শ্রমিক সংকট ও বৃষ্টি আতংকে উদ্বিগ্ন কৃষক

জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া | বুধবার , ২২ নভেম্বর, ২০২৩ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের শস্য ভান্ডার খ্যাত রাঙ্গুনিয়ার গুমাইবিল। এই বিলের কৃষক জরীপ আলী (৫০) এবার ১০০ কানি (১৬ হেক্টর) জমিতে আমন আবাদ করেছেন। মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টিতে বাড়তি টাকা খরচ করে সেচ দিয়ে চাষাবাদের পর ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় তার ৫০ কানি (৮ হেক্টর) জমির আবাদ নষ্ট হয়ে যায়। এরপর আবারও সেই জমিতে চাষাবাদ করার পর মাঝখানে পোকা আতংক ভর করে। সেটি কাটিয়ে যখন ফলন ঘরে তোলার সময় হয়েছে তখন মাত্র দেড় দিনের বৃষ্টিতে গেল সপ্তাহে তার বেশকিছু আধাপাকা জমির ধান হেলে পড়েছে। এখন কাটার মৌসুমে একদিকে অধিক মূল্য দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না ধান কাটা শ্রমিক, অন্যদিকে মেঘলা আকাশে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এতে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তার কপালে। বেশি বৃষ্টি হলে তার কষ্টের ধান কিভাবে ঘরে তুলবেন তা নিয়ে চিন্তিত এই কৃষক। শুধু কৃষক জরীপ আলীই নয়, একই চিন্তা ভর করেছে এই বিলের অন্তত দশ হাজার কৃষকের মনে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত বৃষ্টিতে তেমন ক্ষতি না হলেও বেশি বৃষ্টি হলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকছেই। এক্ষেত্রে কৃষকদের আধুনিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার দ্বারা ধান কাটার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, যাতে অল্প সময়েই ধান কেটে ঘরে নিয়ে যেতে পারেন কৃষকরা।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা লোকন বিশ্বাস জানান, রাঙ্গুনিয়া পৌরসভাসহ উপজেলার ৫ ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত গুমাইবিলে এবার ৩৪৩৫ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। যেখানে কাটারী, মোহন চাষ, ব্রীধান৪৯, ৫১, ৫২, ৮৭, এরাইজডএজেড৭০০৬ সহ বিভিন্ন উন্নত জাতের ধানের আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে বন্যায় ৬০০ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে যায়। যেখানে ক্ষতির মুখে পড়েন বিলের ১৪০০ কৃষক। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি মাঠে নতুন করে চাষাবাদ করানো হয়। বর্তমানে বিলের ধান পাকতে শুরু হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে কাটা পুরোদমে শুরু হবে। এরমধ্যেই গেল সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে মাত্র দেড় দিনের বৃষ্টিতে বিলের অন্তত ১০ হেক্টর পাকাআধাপাকা জমির ধান হেলে পড়েছে। তবে বিলে পানি না থাকায় তা নষ্ট হবে না বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে গুমাইবিলে নমুনা শস্য কর্তন করার পর দেখা গেছে হেক্টর প্রতি ৫.২ থেকে ৫.৪ মেট্টিক টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া গেছে। গেল মৌসুমেও একই পরিমাণ ফলন ছিল। বৃষ্টি না হলে আগামী সপ্তাহে কৃষকরা ধান কেটে ঘরে নিয়ে যেতে পারবেন। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিভিন্ন প্রণোদনায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। প্রত্যেক ইউপিতে তাদের নামের তালিকা জমা আছে। প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছ বলে জানিয়েছেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

সরেজমিনে গুমাইবিলে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি সোনালী ধানে ভরে গেছে বিশাল গুমাইবিল। এরমধ্যে বিলের কিছু কিছু জমির ধান কেটে ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো কৃষক ধান কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বৃষ্টি হওয়ার আশংকায় কোনো কোনো কৃষক বিলে নালা বেঁধে দিচ্ছেন। কেউবা আবার গেল সপ্তাহে হেলে পড়া ধান আঁটি বেঁধে সোজা করে বেঁধে দিচ্ছেন। এসময় কথা হয় বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে। তারা ভারী বৃষ্টি হওয়ার আশংকায় একদিকে আতংকিত, অন্যদিকে চড়া দাম দিয়েও পর্যাপ্ত শ্রমিক প্রাপ্তি নিয়ে হতাশ। তবে শেষ পর্যন্ত কষ্টের আবাদে ভাল ফলন এসেছে। ধানগুলো কেটে ঘরে নিতে পারলেই বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে লাভের মুখ দেখবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন কৃষকরা।

কৃষক মোকাররম জানান, তিনি ৫০ কানি (৮ হেক্টর) জমিতে আমন আবাদ করেছেন। এরমধ্যে ব্রিধান৮৭ জাতের এক একর (আড়াই কানি) জমির ধান কাটার পর হেক্টর প্রতি ৫.৫ মেট্রিক টন ধান পেয়েছেন। বাকি ধান কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সবার ধান একসাথে পাকায় শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা। তাই ধান কাটা শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের খাবার দিয়েও ৭০০৮০০ টাকা পর্যন্ত দৈনিক মজুরী দিতে হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে পুরোদমে কাটা শুরু হলে শ্রমিক না পেলে কিভাবে কাটবো বুঝছি না। এরমধ্যে আকাশ মেঘলা, বৃষ্টি হলে তো মাঠের ধান সেখানেই নষ্ট হয়ে যাবে।

মো. সিরাজুল ইসলাম নামে অন্য একজন কৃষক বলেন, তিনি এবার ৩৫ কানি (৬ হেক্টর) জমিতে আবাদ করেছেন। এরমধ্যে কাটারী জাতের ধান কেটে ঘরে তুলেছেন। যেখানে হেক্টর প্রতি ৫.৮ মেট্টিক টন ফলন এসেছে। তিনিও বৃষ্টি নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন।

এদিকে কৃষি অফিস সূত্রে জানায়, ধান পেকে গেলে জমিতে পানি না জমলে কোনো ক্ষতি হবে না। যেসব ধান হেলে পড়েছে সেগুলোকেও গোছা বেঁধে সোজা করে দেওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে যেসব ধান এখন সফট ডাপ (নরম দানা) অবস্থায় রয়েছে, বৃষ্টিতে সেগুলো কিছুটা ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

গুমাইবিলে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উত্তম কুমার জানান, বিলের কিছু কিছু জমির ধান কাটা শুরু হয়েছে। সাদা পাজাম, উপশির মধ্যে ব্রিধান ৮৭, ৪৯ জাতসহ দেশীয় জাতের কাটারী ধান ইতিমধ্যেই কাটা হচ্ছে। যেখানে হেক্টর প্রতি গড়ে ৫ টন থেকে সাড়ে ৫ টন পর্যন্ত ধান পাচ্ছেন কৃষকরা। রোদ থাকলে আগামী সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে কাটা শুরু হবে।

শ্রমিকের চড়া মূল্য এবং বৃষ্টির শংকা নিয়ে কৃষকের আতংকের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, রাঙ্গুনিয়ায় কম্ভাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ধান কাটার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। পারুয়ায় একটিসহ বাঁশখালী থেকেও আরও হার্ভেস্টার মেশিন আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ধান যেহেতু পেকে গেছে, তাই বৃষ্টি হলেও আতংকিত হওয়ার কিছুই নেই। বৃষ্টি না পড়লে, কিংবা বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে এসবের সাহায্যে অল্প সময়ে কৃষক ধান কাটা থেকে বস্তাবন্দী করা পর্যন্ত করতে পারবেন। কৃষকরা বরাবরের মতোই ভাল ফলন ঘরে তুলে যাতে লাভের মুখ দেখতে পারেন সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা মাঠে থেকে কৃষকদের নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাতকানিয়ায় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিহত
পরবর্তী নিবন্ধআসন ২ হাজার ৪২৪,আবেদন ৭৮,৫৯৯