প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আওয়ামী লীগের যারা গুম–খুনে জড়িত ছিলেন, তাদের সবার বিচার হবে; আর দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কী হবে, সে সিদ্ধান্ত নেবে দেশের জনগণ। গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। এদিন প্রধান উপদেষ্টা ঢাকার তিনটি স্থানে আওয়ামী লীগ আমলে ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেন। এদিনই জুলাই–আগস্টের গণ আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের দমন–পীড়ন নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেসব বিষয় নিয়েও সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন প্রেস সচিব। খবর বিডিনিউজের।
জুলাই গণহত্যায় আওয়ামী লীগের দায় এবং তাদের বিচারের প্রশ্নে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের যারা এই গুম–খুনের ঘটনায় জড়িত ছিল, তাদের সবার বিচার হবে, এটা স্পষ্ট। প্রতিবেদনেও স্পষ্ট, কার নির্দেশে এই খুনগুলো হয়েছে। চার বছরের ছেলে, ছয় বছরের মেয়ে খুন করে লাশগুলো নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। নিহতদের ১৩ শতাংশ শিশু, আমার আপনার ছেলে মেয়ে এরা। সে বিষয়ে যারা যারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল, যাদের হাতে রক্ত, তাদের সবার বিচার হবে, কেউ বাঁচতে পারবে না, এই বিচারের থেকে কারো মুক্তি নেই। তিনি বলেন, আমরা তাদের বিচারের মুখোমুখি করব। সেজন্য শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছি। শেখ হাসিনা এখানে প্রধান, তার নির্দেশে এই খুনগুলো হয়েছে। আওয়ামী লীগ দলের কী হবে সেটা দেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। তারা দেখেছে, গত ১৫ বছরে তারা (আওয়ামী লীগ) কী করেছে। উন্নয়নের গল্প শুনিয়েছে আর আমরা গিয়ে দেখলাম শুধু ডার্ক আর ডার্ক…।
সারাদেশে ৭০০–৮০০ আয়নাঘর : প্রেস সচিব বলেন, বাংলাদেশে যত আয়নাঘর আছে, প্রত্যেকটা খুঁজে বের করা হবে। গুম কমিশনের তদন্ত ও নিরাপত্তা বাহিনীর তদন্ত অনুযায়ী, আমরা জেনেছি এটার (আয়নাঘর) সংখ্যা কয়েকশ। মে বি ৭০০–৮০০। এগুলো আরও বের হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে এটা শুধু ঢাকায় ছিল না, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এরকম অনেক আয়নাঘর ছিল। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় ছয়জন উপদেষ্টা, গুম কমিশনের প্রধানসহ পাঁচজন, পতিত শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে গুমের শিকার হওয়া আটজনকে নিয়ে বহুল আলোচিত আয়নাঘর পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। র্যাবের দুটি ও ডিজিএফআইর একটি আয়নাঘর পরিদর্শন করেন তারা।
সেখানে কীভাবে রাখা হত, কীভাবে নির্যাতন করা হত এবং কীভাবে দিনগুলো কাটিয়েছেন, সেই বর্ণনা দিয়েছেন গুমের শিকার ব্যক্তিরা। কেউ কেউ আছেন ৮–৯ বছর (আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমান) সেখানে ছিলেন, তাদের বর্ণনা শোনা যায় না, ভাষায় প্রকাশ করার মত না। আয়নাঘর পরিদর্শনে সেগুলো প্রকাশ পেয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ টেলিভিশন, আল জাজিরা ও নেত্র নিউজের সাংবাদিকরা ছিলেন। লজিস্টিক্যাল কারণে সবাইকে আয়নাঘর পরিদর্শনে নিতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন প্রেস সচিব।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রতিটি স্থান ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। তিনি বক্তৃতায় বলেছেন, যা দেখেছেন তা বর্ণনা করার মত নয়, অবর্ণনীয়। এটা বীভৎস দৃশ্য, সেটি মনুষ্যত্ববোধ থেকে বহু দূরের। আমাদের সবার অপরাধ যে, এটা আমরা হতে দিয়েছি। গুম কমিশনের রিপোর্ট জাতির জন্য একটা বড় ডকুমেন্ট, এটা পাঠ্য হিসেবে সবাইকে পড়তে হবে। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে। তা না হলে আমরা নিষ্কৃতি পাব না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে প্রেস সচিব বলেন, তাদেরকে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, এই গুম–খুনের সঙ্গে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ছিল, তার নির্দেশে এগুলো হয়েছে বেশিরভাগ। গুমের ঘটনায় জড়িত অনেকের এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট হয়েছে, গুম কমিশন কাজ করছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই কেসগুলো দেখছে, তারা কাজ করছে। আপনারা যথাসময়ে এগুলোর রেজাল্ট পাবেন।
আয়নাঘরের আলামত নষ্ট করার যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সেটি গুম কমিশন দেখছে। সে অনুযায়ী এটার ওপর কেইস হচ্ছে। অপরাধ ট্রাইব্যুনালও প্রসিকিউটররাও দেখছে। আমরা প্রত্যেকটা জিনিস দেখছি এবং সেই আলোকে গুমের এভিডেন্স হিসেবে প্রত্যেকটা আয়নাঘর সিলগালা করা থাকবে। কারণ, লিগ্যাল প্রসেসে এটা লাগবে। আলামত নষ্ট হওয়া এটা মনে হওয়ার বিষয় না, লিগ্যাল বিষয়। তবে আমরা কিছু কিছু জায়গায় দেখেছি, কিছু জায়গায় প্লাস্টার করা হয়েছে, কোনো জায়গায় রুমটা একটু ছোট ছিল সেটা দেয়াল ভেঙে বড় দেখানো হয়েছে…। সত্যিকার অর্থে এটা ইচ্ছাকৃত নাকি ইচ্ছাকৃত নয় এগুলো তো গুম কমিশন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার করবে। সেজন্য কমিশন থেকে বলা হয়েছে, এগুলোর প্রত্যেকটা সিলগালা করা থাকবে, এটা ওপর আরও ইনভেস্টিগেশন হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, ছাত্র–জনতার জুলাই অভ্যুত্থানে নির্যাতন, খুন করা হয়েছে, ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন করা হয়েছে বা ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে, আহতদের চিকিৎসা নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। এখানে দল হিসেবে কার কী ভূমিকা ছিল, ব্যক্তি হিসেবে কার কী ভূমিকা ছিল সেসব বিষয়ে প্রতিবেদনটিতে বিশদভাবে উঠে এসেছে। তিনি বলেন, প্রতিবেদনটিতে জুলাই–আগস্টের অভ্যুত্থানে প্রায় ১৪শ নিহত ও হাজার হাজার আহতের কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘ তাদের নিজস্ব কৌশলের (মেকানিজম) মাধ্যমে তদন্ত করে এই তথ্য দিয়েছে।
সরকারের কাছে যে–সব তথ্য চেয়েছে, সেগুলো দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে সেটিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আছে। প্রতিবেদনের একটা জায়গায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং বলেছেন– প্রটেস্টার যারা আছে, তাদের হত্যা করতে হবে এবং তাদের পাকড়াও করে হত্যা করে মরদেহকে সরিয়ে বা লুকিয়ে ফেলতে হবে। এটা সাক্ষীর ভিত্তিতে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা। এ ছাড়া একটা কোর কমিটির কথাও বলা হয়েছে যেটা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে করা হয়। তিনি এই কোর কমিটির বৈঠকে কীভাবে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করে জুলাই অভ্যুত্থানকে দমন করতে হবে, সেই নির্দেশ দিয়েছেন।
আজাদ মজুমদার বলেন, সাবেক সরকারের রাজনৈতিক দল এবং তাদের ছাত্রসংগঠনের কার কী ভূমিকা ছিল সেগুলো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। আন্দোলন দমনে নিরাপত্তা বাহিনী থেকে ঢাকার সংসদ সদস্যদের মানুষকে অস্ত্র সরবরাহের বর্ণনা রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কীভাবে পুলিশের ছত্রছায়ায় আক্রমণ করেছে, হত্যা করেছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর কার কী ভূমিকা ছিল তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
আয়নাঘর পরিদর্শন এবং জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রতি ইঙ্গিত করে উপপ্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর বলেন, আমরা যা দেখেছি এবং ভিডিও ফুটেজে আপনারাও যা দেখেছেন; এই দুইটা জিনিস একটু সাম–আপ করলে ওভারওল গত ১৫ বছরের বাংলাদেশে কী হয়েছে তার একটা বড় অংশ উঠে এসেছে দুইটা ঘটনায়। কসাই শেখ হাসিনার যে লিগেসি, তার সাম–আপ করার একটা বড় অংশ এই দুইটা।