বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বাংলাদেশে ক্ষেত্রবিশেষে অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। গুজব ও অপপ্রচারের কারণে বেশির ভাগ ব্যবহারকারীর কাছে এটির গুরুত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। গত ২৮ জুলাই দৈনিক আজাদীতে ‘ফেসবুকে গুজব, সচেতন হওয়ার পরামর্শ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান সময়টাকে বলা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা আর হাতে হাতে স্মার্টফোন মানুষকে করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমমুখী। বিশ্বায়ন আর শিল্পায়নের এ যুগে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। এক হিসেবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ফেসবুকের নীল জগতে বুঁদ হয়ে থাকেন। মানুষের আবেগ–অনুভূতি, মতামত, বন্ধুত্ব সবকিছু এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে। নানা সামাজিক–রাজনৈতিক পরিবর্তনের নেপথ্যেও এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ শক্তিকে ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ চক্র ছড়িয়ে দিচ্ছে নানা ধরনের গুজব। সামপ্রতিক বছরগুলোয় ফেসবুকে ছড়ানো গুজবে কান দিয়ে বেশ কয়েকটি সহিংসতা এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একটি মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, এমন গুজব ছড়াচ্ছে– যেগুলো শুনে সাধারণ মানুষও ঠিক থাকতে পারে না। বিভ্রান্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা তাই বলছেন, ফেসবুকের ব্যবহার নিয়ে সচেতন হতে হবে এখনই।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মূলত ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, লাইকি, টিকটকসহ সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে ভিউ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। সেসব পোস্ট অনেকে জেনে বা না জেনে শেয়ার করছে, যা একসময় ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে একদিকে যেমন অনিরাপদ হয়ে উঠছে এই মাধ্যম, তেমনি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অনেকে করছে আইনের লঙ্ঘন। জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংগঠন আভাজের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুকের বিভিন্ন গুজব ও অসত্য কনটেন্টের কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ভুল তথ্যের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২০ সালে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়। সে সময় ফেসবুকে স্বাস্থ্যবিষয়ক যেসব ভুল তথ্য উঠে এসেছিল, তা মাত্র এক বছরে ৩৮০ কোটি বার দেখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, করোনা সংকটকালে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুবাদে স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। অনেকে এটিকে ভালো কাজে ব্যবহার করলেও কেউ কেউ জড়িয়ে যায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। ফেসবুক, টিকটক, লাইকির মতো ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে যুক্ত হয়ে অপরাধের নানা কৌশল আয়ত্ত করতে থাকে। এমনকি এসব প্ল্যাটফরমে সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধে জড়াতে থাকে অনেক গ্রুপ। বিভিন্ন এলাকায় আগে থেকেই সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অনলাইনকেই বেছে নেয় যোগাযোগের বড় মাধ্যম হিসেবে। বর্তমানে তারা আরো বেশি সক্রিয় ও সংঘবদ্ধ।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সৎ সাংবাদিকতা–অবাধ সংবাদ প্রবাহ সমাজ সমৃদ্ধিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পক্ষান্তরে অপসাংবাদিকতা–মিথ্যাচার–প্রতারণার মোড়কে বৃহত্তর সহজ–সরল জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করার দৃষ্টান্তও নেহায়েত কম নয়। যেকোন জাতিরাষ্ট্রে অপকৌশলের বেড়াজালে মিথ্যার বেসাতি সাবলীল ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি কলুষিত করে। প্রতিহিংসা–পরশ্রীকাতরতা নানামুখী অপচেষ্টায় এমন কদাচার পরিবেশ তৈরি করে যাতে সর্বাধিক স্থিতিশীল সরকারকেও বহুধাবিভক্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ফেসবুকে সংবাদ প্রচারও এক ধরনের সাংবাদিকতা। এটাকে সিটিজেন জার্নালিজম হিসেবে আখ্যায়িত করছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা। সেই মাধ্যম যদি অপপ্রচারে লিপ্ত হয়, তাহলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এখন তথ্য–প্রযুক্তির সুবাদে সারা বিশ্ব হাতের মুঠোয়। যা পাচ্ছে লুফে নিচ্ছে কিশোর বা তরুণরা। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের জায়গাটা তারা গুলিয়ে ফেলছে। এ জন্য অভিভাবকদের দায়ও কম নয় বলে মনে করছেন তাঁরা। তাই তাদের প্রতি নজরদারি আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
আমরা জানি, ২০৪১ সালে যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার কর্ণধার হতে যাচ্ছে আজকের শিক্ষার্থীরা। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রয়োজন স্মার্ট জেনারেশন। যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হবে মিতব্যয়ী, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে হবে দৃঢ় প্রত্যয়ী, তারা প্রচলিত শিক্ষার পাশাপাশি অংশগ্রহণ করবে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে; যে স্মার্ট জেনারেশনকে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে হতে হবে আরও সচেতন। তাদেরকে সকল প্রকার সন্ত্রাস, অপরাধ ও গুজবের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব ধারণ করতে হবে।