গান তো শুনছি সেই মায়ের কোলে বসে। তারপর তো রেডিও–তে শুনতাম। পরে লংপ্লে, ক্যাসেটে শুনেছি। কিন্তু কথা হলো: গান তো শুনছি… গায়কই গানের লেখক। তিনিই সুর করে গাইছেন। ছোটো বেলা থেকে কেন যেন এমন ধারণাই হতো। এমনটি হওয়ার বড় কারণ – ক্যাসেটের কভারে কে গান লিখেছেন তার নাম উল্লেখ থাকতো না। কণ্ঠ শিল্পীর নামই থাকতো। যাহোক, পরে তো জানলাম: গান লেখেন একজন। সুর করেন আরেকজন। গাইছে অন্যজন। আবার বাদ্যযন্ত্রীর দলও আছে। এরা অবশ্য বরাবরই নেপথ্যের কারিগর। মূল ফোকাসটা পরে কণ্ঠশিল্পীর উপরই। যাহোক, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবেশও বদলেছে। এখন গীতিকার ও সুরকারের নাম থাকে। জনপ্রিয় গানের গীতিকার – সুরকার কে? এ নিয়ে কৌতুহল সর্বদা ছিল – এখনো আছে।
বাংলাদেশের স্বনামধন্য বারো গীতিকবির জীবনালেখ্য নিয়ে চমৎকার একটি প্রকাশনা হয়েছে। নাম: গীতিজীবন। দেশের বরেণ্য এই গীতিকবির বিষয়ে আমরা যারা শ্রোতা আছি, জানি না তাদের সম্পর্কে। এই কৌতুহল মেটাতে বেশ কষ্টসাধ্য কাজটি করলেন মাহমুদ মনজুর। সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত মনজুর। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গীতিকবিদের জীবন, গান লেখাকে তার লেখার উপজীব্য করে নেন। তিনশত পৃষ্ঠার এই বইতে আমরা জানতে পারি স্বনামধন্য গীতিকবিদের সম্পর্কে। এরা হলেন: মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, মুনশী ওয়াদুদ, মনিরুজ্জামান মনির, লিটন অধিকারী রিন্টু, নাসির আহমেদ, জাহিদুল হক, শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, কবির বকুল, আসিফ ইকবাল, শহীদুল্লাহ ফরায়জী, জুলফিকার রাসেল। এখানে উল্লেখ্য, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখাটি পূর্ণাঙ্গ করা সম্ভব হয়নি। আকস্মিক না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন এই গুণী গীতিকবি ও সংগীতজ্ঞ।
উপরে বর্ণিত গীতিকবিদের নাম এবং তাদের লেখা গানের সাথে আমরা অনেকটাই পরিচিত এখন। বিশ/ পঁচিশ বছর আগেও পরিচিত ছিলাম না – যখন গানগুলো প্রথম শোনা হয়।
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকবি। সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পারে দাঁড়িয়ে, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম, দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক, ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়, আমার মন পাখিটা যায়রে উড়ে যায়, পদ্ম পাতার পানি নয় দিন যাপনের গ্লানি নয়, আকাশের সব তারা ঝরে যাবে – এমন মনে রাখার মতো গান লিখেছেন তিনি। অথচ বালকবেলায় স্কুলে পড়াকালীন রফিকউজ্জামানের আঁকা ছবি দেখে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাকে বলেছিলেন: ‘এই ছেলে… তোমার স্কেচ তো দারুণ। তুমি এক কাজ করো, মেট্রিক পাস করে ঢাকা আর্ট কলেজে চলে এসো।’ সবকিছুই ঠিক ছিল। মেট্রিক পাসও করলেন। আর্ট কলেজেও যাবার মানসিক প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু বাংলায় লেটার মার্ক পাওয়ায় বড় ভাই ড. মনিরুজ্জামান (অধ্যাপক ও কবি) বললেন: ‘যেহেতু লেটার মার্কস পেয়েছিস, তোকে বাংলায় পড়তে হবে’। আর্ট কলেজে আর পড়া হলো না। জীবনের মোড় গেল ঘুরে। কবিতা লেখার শুরুটা হয় স্কুলে পড়াকালীন। পরে বন্ধু হীরা ও লাট্টুর প্রেরণায় গান লেখা। রেডিওতে গান শুনে শুনে বোঝা ও লেখার ধরন কেমন –তা বোঝেন। পরে গান লেখা শুরু। ১৯৬৫ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম গান রেকর্ড হয়। পঁচিশটি গান রেডিওতে পাঠিয়ে শুরু হলো গীতিকবি রফিকউজ্জামানের নতুন অধ্যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতারে চাকরি করলেন। চাকরির পাশাপাশি রফিকউজ্জামান শতাধিক চলচ্চিত্রের কাহিনি– চিত্রনাট্য–সংলাপ রচয়িতা। তার প্রকাশিত গানের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। ১৯৮৪ ও ১৯৮৬ সালে শ্রেষ্ঠ গীতিকার এবং ২০০৮ সালে শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২৪ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন।
‘তোমার চন্দনা মরে গেছে’ – মিতালী মুখার্জির গাওয়া এই গানটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। এখনো হয়তো অনেকেই গায়, গুনগুনিয়ে। তুমুল আলোড়ন তুলেছিল গানটি। এই গানটির গীতিকার হলেন মুনশী ওয়াদুদ। ‘নাখালপাড়ার জমিদার’ হিসেবে খ্যাতি তার। তার গান লেখা শুরু ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এখনো লিখছেন। রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা মিলিয়ে তার লেখা গানের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। সিনেমার জন্যও অনেক গান লিখেছেন তিনি। পাশাপাশি সিনেমার সংলাপ, চিত্রনাট্যও লিখেছেন।
যারে ঘর দিলা, কিছুই নাকি দেইনি তোমায়, জন্মিলে মরিতে হবে ( কুমার বিশ্বজিৎ), একদিন ঘুম ভেঙে দেখি (শেখ ইশতিয়াক), কী করে আমায় তুমি ভুলবে (শাহনাজ রহমতুল্লাহ), কখনও জীবন যেন সুরভিত ফুল (রুনা লায়লা), পরেছি লাল শাড়ি (বেবী নাজনীন), বাঘের পিছে বাঘ লাগে না (ফকির আলমগীর ও ফেরদৌস ওয়াহিদ) ইত্যাদি জনপ্রিয় গানগুলো নিশ্চয়ই মনে আছে শ্রোতাদের। ব্যাপক জনপ্রিয় গানগুলোর গীতিকবি হলেন লিটন অধিকারী রিন্টু। তিনি আজও গান লিখছেন। তার জনপ্রিয়তা এবং তার সৃষ্টির মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে আজও। আমরা জানি কুমার বিশ্বজিৎ এবং লিটন অধিকারী রিন্টু দারুণ এক জুটি। অনেক জনপ্রিয় গান আছে তাদের। তবে প্রয়াত শেখ ইশতিয়াকের বন্ধুত্বের সূত্র ধরে গান লেখা শুরু। গিটারিস্ট হিসেবে মিউজিকের জগতে যাত্রা শুরু রিন্টুর। তারপর তো দীর্ঘ সংগীত পরিভ্রমণ। সবচেয়ে মজার ও বিস্ময়ের বিষয় এই –গিটারিস্ট হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত হলেও গীতিকবি হিসেবে রেডিও– টেলিভিশনে এনালিস্টেড নন রিন্টু। তাতে কী… তার লেখা অনেক জনপ্রিয় গান প্রচারিত হয়েছে এই দুই মাধ্যমে।
এবার বলি শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর কথা। বাংলা ব্যান্ড মিউজিক এবং আধুনিক গানের জগতে বৈচিত্র্যময় গান লিখে আলোড়িত করেছেন শ্রোতাদের মন। যেমন: আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, একদিন ঘুম ভাঙা শহরে, আজ যে শিশু, হৃদয় কাদামাটির কোনও মূর্তি নয়, সময় যেন কাটে না, চায়ের কাপে পরিচয়, আমি ভুলে যাই তুমি আমার নও, হে বাংলাদেশ তোমার বয়স হলো কতো?, তৃতীয় বিশ্ব – ইত্যাদি গানগুলো আমাদের জগতকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি বৈচিত্র্য এনেছে। গানের বিষয়বস্তু সময়কে যেমন উপস্থাপন করেছে, আবার মানব মনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকেও তুলে ধরেছে। এজন্য শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর গান মানেই অন্যরকম। ভিন্ন স্বাদের।
‘গীতিজীবন’ বইটি মাহমুদ মনজুরের দীর্ঘ সময় ধরে গীতিকবিদের নিয়ে ব্যতিক্রমী উপস্থাপন। যা কখনোই জানা সম্ভব ছিল না বইটি প্রকাশ না হলে। এই প্রসঙ্গে মনজুর বলেন, ‘একটি তাগিদ অনুভব করলাম যে, একটি দরকারী গ্রন্থ তৈরি করার। যেটি আগে কেউ করেনি। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বারোজন গীতিকবির জীবনচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। গীতিকবিদের নিয়ে ভবিষ্যতেও এমন ধারাবাহিক কাজ করে যাবো।’ তার এই ইচ্ছেকে সাধুবাদ জানাই।
আজব প্রকাশের স্বত্বাধিকারী জয় শাহরিয়ারকেও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ‘গীতিজীবন’–এর মতো ব্যতিক্রমী বই প্রকাশ করে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী।











