বাংলাদেশের সীমানায় করোনা প্রবেশের প্রথম দিককার কথা। কাগজে–কলমে লকডাউন চলছিল তখন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য ভরা চৈত্রের এক দুপুরে দায়িত্ব পালন করছিলেন নগরীর এক ব্যস্ত মোড়ে দাঁড়িয়ে। মাস খানেক আগেও এখানকার যানজট ছাড়াতে নাভিশ্বাস হত তার। আর এখন? সকাল থেকে অনেকজনকে রিকশা থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মানুষের অজুহাতের শেষ নেই। এত তুচ্ছ কারণে কোভিডের তোয়াক্কা না করে বাড়ির বাইরে আসে! আহারে যদি ছুটি পাওয়া যেত বাড়ি যাবার! সাতপাঁচ ভাবতেই ঝকঝকে এক গাড়ি সামনে এসে পড়ে। পুলিশকর্মী ভাবলেন– ভাল করে রাগ ঝাড়বেন এবার। যথারীতি থামিয়ে দিয়ে কড়া গলায় গাড়ির চালককে হুকুম দেন– নেমে আসো। চালকের আসন থেকে নেমে আসেন সুদর্শন তরুণ, দেখেই বোঝা যায় দুই পয়সার পেশাদার গাড়িচালক নন। মুহূর্তেই পুলিশের চোখ মুখের ভাষা পাল্টে যায়। তারপর সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে পুলিশকর্মীর এবং অদূরে দাঁড়ানো প্রশাসনিক কর্মকর্তার কথোপকথনের বৃত্তান্ত আমাদের না জানলেও চলবে। এবার বরং অন্য একটি দৃশ্যে চোখ ফেরানো যাক।
নগরীর এক অভিজাত এলাকার গৃহস্বামীদের পরিষদ সেই এলাকায় কর্মরত এই মুহূর্তে কর্মহীন গৃহকর্মীদের কিছু সাহায্য দিয়ে ত্রাতা হিসেবে নাম কেনার আশায় অর্থ সংগ্রহ করেন বেশ ঘটা করে। প্রতি অট্টালিকার দ্বাররক্ষীরা ঘরে–ঘরে গিয়ে সবার গৃহকর্মীদের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে। সপ্তাহ পেরিয়ে যাবার পর গৃহকর্মীদের জানানো হয় জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিতে হবে। ওরা দরিদ্র দীনহীন সন্দেহ নেই, স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক তাতেও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু নিয়ম শৃঙ্খলা বলে একটা কথা আছেন! কাগজ–কলমে সব যাচাই করে নেওয়া চাই। কিন্তু এই দুর্যোগে ফটোকপির দোকান কোথায় পাই! পড়িমরি করে দোসরা বৈশাখের আগুনঝরা দুপুরে মাইল খানেক হেঁটে গিয়ে কেউবা ফটোকপির ব্যবস্থা করে। অবশেষে তা প্রদর্শনপূর্বক ত্রাণ গ্রহণ। সবাই তো ফটোকপি করাতে পারে না। অনেকের কাছে পরিচয়পত্রই নেই। ঘরে আগুন লেগেছিল কয়েকজনের ঘরে। যৎসামান্য জামাকাপড়, হাঁড়িকুঁড়ি, বিছানা বালিশের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রও পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। এতসব অজুহাত টালবাহানা শোনার সময় নেই ত্রাতাব্যক্তিগণের। অতঃপর অভিজাত এলাকার দৃষ্টিনন্দন প্রধান ফটক হতে অনেক গৃহকর্মীর শূন্য হাতে প্রত্যাবর্তন।
ওপরের দুটি দৃশ্য আমাদের সমাজের প্রকৃত চিত্র। আজ নয়, যুগ যুগ ধরে চলছে এধরনের দৃশ্যের মঞ্চায়ন আমাদের চারপাশে। আমাদের সমাজ, আমাদের আইন গরিবের বেলায় বড়ই নীতিবান, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে, এক বিন্দু ছাড় দেয়া চলেনা। এ–নিয়ে অনেক কথা হয়, লেখালখি হয়। বদলায়না কোন কিছু। বদলাবেইবা কেমন করে! শ্রেণীবৈষম্যের প্রথম পাঠ যে পরিবার থেকে পাওয়া। তাছাড়া আমাদের গণমাধ্যমের বিনোদনমুলক অনুষ্ঠানে, এমনকি শিশুতোষ গ্রন্থগুলোতে গল্পে গল্পে শেখানো হয় গৃহস্বামী ও গৃহকর্মীদের অবস্থানগত পার্থক্যের বিষয়টি। বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের শিশুদের জন্য লেখা এক বইয়ের ছোট্ট একটা দৃশ্য– কাজের ছেলে বয়সে ঘরের ছেলের চেয়ে বেশ বড়। ঘরের ছেলেটি তাকে তুই তুই করে বলে, অপরদিকে কাজের ছেলে তাকে ভাইয়া বলে, আপনি করে ডাকে। শুধু তাই নয়, ঘরের ছেলেটি কাজের ছেলেকে নির্দেশ দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়, ধমক ধামক দেয়; অপরদিকে কাজের ছেলেটি জ্বি ভাইয়া করে যায়। আমার মেয়ের কাছে খটকা লাগে। ওর সোজা প্রশ্ন– ‘মা, তুমি বলেছ– বড়দের সম্মান করতে। গল্পের ছেলেটিতো বয়সে ছোট। ও কেন রতনকে তুই তুই করে? আবার রতইন্না বলে?” আমার মেয়ে নয় বছর বয়সে এই প্রশ্ন তুলেছিল। চৌদ্দতে পড়ল বলে। আজও ওর প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি।
আমাদের নামজাদা শিক্ষাবিদ, লেখক ও সংস্কারকর্মীগণ এ–বিষয়টা এভাবে কখনও ভেবে দেখছেন কী? আমাদের আদিপুরুষগণ গরিবের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে গেলেন, আমরাও ওদের শ্রম ঘাম রক্তের ওপর ভর করে মজবুত জাতীয় অর্থনীতি নির্মাণ করছি, গৃহস্থালি জীবনে আজও দাসপ্রথাকে কার্যকর রেখে চলেছি। আমাদের সুশীল সমাজ অভিজাত পারিবারিক আবহে গৃহকর্মীদের মা–বাপের দেয়া নাম মুছে ফেলে ঢালাওভাবে ‘বুয়া’ উপাধি দিয়ে অমানবিক আচরণ করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। আবার বইপত্রের মাধ্যমে আমাদের সন্তানদের আচরনে শ্রেণীবিদ্বেষের বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বড় হয়ে ওরা হয়তো নামীদামী মানুষ হবে, সোনালি জিপিএ’র বদৌলতে প্রথম শ্রেণীর নাগরিকও হবে, তবে রতইন্নাদের মানুষ বলে গণ্য করবেনা, সম্মান করাতো অনেক পরের কথা। এমনি করেই কী এগিয়ে যাবে আমাদের বংশধারা! আমাদের সন্তানদের মানবিক মানুষ করার জন্য আমরা কী পুরনো ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে আসবোনা! ওদেরকে সাম্যের গান শেখাব না!
করোনাকালের স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত একটি ছোট্ট গল্প শোনা যাক এবার। ছুটিতে থাকা গৃহকর্মীর দুই মেয়ে, আমার মেয়ের চেয়ে ছোট। মেয়েদের বাবা অন্য নীড়ে ঘর বেঁধেছে। দু’চার দিন পর পর মা–মেয়ের খোঁজ খবর নেই মুঠোফোনে। ওকে সাবধান করি– মেয়েদের বাইরে যেতে দেবেনা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে, পাশের ঘরে টেলিভিশন দেখতে যেতে দিওনা, নিজের যত্ন নিও, মেয়েদের জন্যইতো তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে— এমন অনেক কথা। ওর এক কথা– টেলিভিশন দেখতে না দিলে মেয়েদেরকে নিয়ে কী–ইবা করবে সে দিনরাত! এরপর সে বলে মোক্ষম কথাটা– টেলিভিশনতো খালি বড়লোকদের নিরাপত্তা সুরক্ষা নিয়ে কথাবার্তা বলে ; হাত ধোয়া’র ছবি, ঘরে থাকার ছবি, পরিবার নিয়ে আনন্দ করার ছবি। ওর সোজাসাপ্টা কথা– ‘আফা আমরার মতো গরিবগো মনে হয় এই অসুখ অইতনা। আমরার কাছে খিদাই বড় অসুখ’। তবে কেবলই ভাতের খিদে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আমিষ, লৌহ, খাদ্যপ্রাণ ওদের লাগে না।
গল্প আর দৃশ্যের ভার আর বাড়াতে চাইনা। সবশেষে ছোট্ট একটা বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সংবাদপত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত বা সাক্ষাৎকার প্রতিদিনই আসছে। সবার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ, নিঃসন্দেহে। করোনাকালে ত্বকের যত্নও নিছক হেলফেলার বিষয় নয়। ত্বক বিশেষজ্ঞের কাছে সংবাদকর্মীর জিজ্ঞাসা– “বাড়ীতে গৃহকর্মী না থাকায় এখন ধোয়ামোছার কাজ অনেক বেড়ে গেছে, অনেকের হাতের চামড়া খসখসে হয়ে যাচ্ছে…আরও সমস্যা– এমতাবস্থায় হাতের যত্নে কী করা উচিত?” তাজ্জব বনে যাই– প্রশ্ন শুনে। প্রথম অংশটা জুড়ে না দিয়ে এমনিতেই প্রশ্নটা করে যেত। এই শহরে একজন গৃহকর্মী দিনে অন্তুত তিন বাড়িতে ধোয়ামোছা, মাজাঘষা, কোটাবাছা করে, যার সবই পানির কাজ। ওদের শরীর কী তবে রক্ত–মাংসে গড়া নয়? ওদের ত্বক কী পানিনিরোধক কোন ধাতু দিয়ে বাঁধাই করা? আমরা শিক্ষিত, ধনবান, রুচিবান নাগরিকরা কী কোনদিন ওদের হাতের ত্বকের দিকে খেয়াল করেছি? গ্রহণকাল কেটে গেলে আবার যদি ওরা কাজে ফিরে আসে, তখনও কী আমরা ওদের ভালমন্দ দেখবনা?
সাম্যের গান গাইবার কথা নিয়ে লেখা শুরু করলেও প্রকৃতপক্ষে গৃহকর্মী তথা নিম্ন আয়ের মানুষদেরকে অভিজাতদের সমান্তরালে নিয়ে আসা আজকের বাস্তবতায় অসম্ভবই বলা চলে। তবে ওদেরকে মানুষ বলে মর্যাদা ও সম্মান করা এবং ওদের সুখদুঃখের দেখভাল করা খুবই সম্ভব, কেবল আমরা যদি মানবিক বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হই। দাহনকাল থেকে এই শিক্ষাটা অন্তত আমরা গ্রহণ করতে পারি।