সদ্য দায়িত্ব নেওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে, তার আগে নয়। গতকাল রোববার শপথ গ্রহণের পর নতুন চার কমিশনারকে নিয়ে নির্বাচন ভবনে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো মতবিনিময়ে আসেন সিইসি। নির্বাচন কবে নাগাদ হতে পারে সেখানে এমন প্রশ্নে নাসির উদ্দীন বলেন, দিনক্ষণ দিয়ে বলতে পারব না কবে নির্বাচন হবে। আমাদের তরফ থেকে প্রস্তুতি আজ থেকেই শুরু করব।… তবে ইলেকশন করার জন্য যে যে রিফর্ম প্রয়োজন, সেটা ছাড়া নির্বাচন সম্ভব না। ফেক ভোটার আছে শুনেছি, রাজনৈতিক দলের মধ্যেও (সংসদ) দ্বি–কক্ষ হবে নাকি বর্তমানের মতোই থাকবে তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। কেউ চায় আনুপাতিক হারে নির্বাচন, কেউ চায় এখনের মতোই। এসব বিষয়ে ফয়সালা না হলে আমরা কীভাবে প্রস্তুতি নেব? রিফর্ম কমিশন থেকে সাজেশন আসবে। সবার থেকে পরামর্শ ইনকরপোরেট করে তারপর ফ্রি ফেয়ার নির্বাচন হবে। খবর বিডিনিউজের।
তিনি বলেন, আমাদের সকল প্রচেষ্টা নিবিড়ভাবে থাকবে যাতে একটা ফেয়ার, ক্রেডিবল নির্বাচন করা যায় এবং এর জন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত করব। একটা ফেয়ার ও ক্রেডিবল নির্বাচন দেওয়ার জন্য যা যা করার দরকার করব। এর আগে দুপুর দেড়টায় সুপ্রিম কোর্ট জাজেজ লাউঞ্জে নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে শপথ পড়ান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। শপথ শেষে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য কমিশনারদেরকে নিয়ে নির্বাচন ভবনে আসেন সিইসি। সেখানে দুপুরের খাবার ও আছরের নামাজের পর সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে বসে নতুন নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগ ও এর জোটবদ্ধ দলগুলোর নির্বাচনে আসার প্রশ্নে সিইসি বলেন, রিফর্ম কমিশনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও সহযোগীদের ব্যাপারে ফয়সালা হলে বলতে পারব। এটা তো জাতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এখন মন্তব্য করতে চাই না।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন করা হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বদিউল আলম মজুমদার। গঠনের পর থেকে সেই কমিশন বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করে সুপারিশ নিচ্ছে। সেসব সুপারিশ যাচাই–বাছাই শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে কমিশন।
সরকারের সংস্কার কমিশনের উদ্যোগগুলো তুলে ধরে সিইসি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় বারবার বলেছেন, আপনারা রিফর্মসের সুপারিশগুলো আমাকে দেন; আমি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বসব। রাজনৈতিক দলগুলো যেসব সুপারিশে একমত হবে সেগুলো আমরা গ্রহণ করব; যেখানে বিতর্ক হবে, কোনো কোনো দল মানবে না, সেগুলো রেখে যাবে, পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে দিয়ে যাবে। সুতরাং সংস্কার কমিশনের যে সুপারিশগুলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য… আমরা কাজে নেমে পড়ব। তবে আমাদের তরফ থেকে আমরা যথাসম্ভব নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি ফ্রম টুডে, আমরা নেব আমাদের তরফ থেকে। কিন্তু (নির্বাচন করতে) পারব না তো, রিফর্মসগুলো না আসলে পারব না।
নতুন সিইসি বলেন, নির্বাচন করার জন্য যে যে সংস্কারগুলো করা দরকার, যেগুলো ছাড়া করা যাবে না এবং অনেকগুলো রিফর্ম কমিশনের ইন্টাররিলেটেড। শুধু বদিউল আলম মজুমদারের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে করা যাবে না; যদি স্থানীয় সরকার, সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত না হলে।
নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার শেষে ভোট কিনা জানতে চাইলে এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেন, অ্যাবসলিউটলি। নির্বাচন রিলেটেড এসেনসিয়াল রিফর্মগুলো হলেই তারপরে হবে; না হলে আমার পক্ষে সম্ভব না। নতুন নির্বাচন কমিশনের ওপর চ্যালেঞ্জ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ একটাই, একটা ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা।
এই কমিশন একতরফা নির্বাচনে বিশ্বাসী না উল্লেখ করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের কোনো দল নাই। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নাই। আমাদের ওপর তাই কোনো রকম চাপ নাই।… আমি কনভিন্সড সামনেও কোনো চাপ থাকবে না।
গায়ের জোরে ইলেকশন নয় : বিগত সময়ের কথা উল্লেখ করে সিইসি নাসির বলেন, আমাদের সকল প্রচেষ্টা নিবিড় থাকবে যাতে, একজন ভোটার নিজের পছন্দের মানুষকে নির্বিঘ্নে ভোটটা দিতে পারে, সে রকম পরিবেশ নিশ্চিত করব ইনশা আল্লাহ। এটা করার জন্য আমাদের যা যা করা লাগে করব। আর আমরা একতরফা নির্বাচনে বিশ্বাসী না। একতরফা নির্বাচনকে দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখেন তিনি।
সিইসি বলেন, একতরফা করেই তো দেখছেন, দেশের কী বারোটা বেজে গেছে। এই একতরফা করেই তো, গায়ের জোরে নির্বাচন করলে যা হয়। আমরা কোনো গায়ের জোরে ইলেকশন দেখতে চাই না। একতরফা ইলেকশন দেখতে চাই না। আমরা একটা প্রতিযোগিতামূলক, আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ক্রিয়েট করে দিব, যাতে করে এখানে সবাই খেলতে পারে, আমরা সেই ব্যবস্থাটা করব। আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে শতভাগ। ফেয়ারনেস নিশ্চিতে শতভাগ চেষ্টা থাকবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের পাঠিয়েছেন : বিগত সরকারের সময়ে তিন নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে সেসব যেন না হয়, তার জন্য আল্লাহ তায়ালা এই কমিশনকে পাঠিয়েছেন বলে মন্তব্য তার। তিনি বলেন, আগে নির্বাচন হয়েছে, ডামি নির্বাচন হয়েছে, ১৫৩ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। এগুলোর জন্যই আমাদের আসা। আমাদের আগমন কিন্তু ওইগুলো মোকাবেলা করার জন্যই। এ রকম যাতে না হয় এজন্য আল্লাহ তায়ালা আমাদের পাঠিয়েছেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে। এই দায়িত্বকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে জাতির জন্য কিছু করার প্রতিশ্রুতি দেন সিইসি।
তার ভাষ্য, দিস ইজ দ্য গ্রেট অপরচুনিটি। আমি এটাকে একটা মহৎ সুযোগ হিসেবে নিয়েছি। আপনার চ্যালেঞ্জ বলছেন তো, আমি এটাকে অপরচুনিটি হিসেবে নিচ্ছি। জীবনের শেষ বয়সে এসে আমরা একটা অপরচুনিটি পেয়েছি জাতির জন্য কিছু করার জন্য। আমার কলিগদের সঙ্গে নিয়ে। আমরা এখন ফিল করছি যে, আমাদের শেষ জীবনে এসে সুযোগ এসছে। আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। এই সুযোগটার সদ্ব্যবহার আমরা করি। এখানে যদি আমরা ফেল করি, তাহলে এই দেশের ভোটিং সিস্টেমের কী হবে আপনারাই জানেন।
স্বচ্ছ নিয়োগ : এই কমিশনের নিয়োগকে পুরোপুরি স্বচ্ছ দাবি করে সিইসি বলেন, তার কমিশনারদেরও তিনি চিনতেন না। আমাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ভেরি ট্রান্সপারেন্ট প্রসেসে। ভেরি ট্রান্সপারেন্ট প্রসেস। নিয়োগের বিষয়টি টেলিভিশনে স্ক্রল দেখে প্রথম জানতে পারেন বলে ভাষ্য নাসির উদ্দীনের। তিনি বলেন, কারো কোনো ডিজায়ারের কারণে আমাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। একটা ট্রান্সপারেন্ট প্রসেসের মাধ্যমে আমরা আসছি।
শপথ নেওয়া নতুন চার নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, আবদুর রহমানেল মাসুদ, তহমিদা আহ্মদ ও আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ মতবিনিময়ে উপস্থিত ছিলেন।