গান ও দর্শন চেতনায় মরমী শিল্পী হাছন রাজা

রূপম চক্রবর্ত্তী | মঙ্গলবার , ২৫ মার্চ, ২০২৫ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী হচ্ছেন হাছন রাজা। মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি লালন শাহ্‌ এর প্রধান পথিকৃৎ ছিলেন। পার্থিব সম্পদ, আকাঙ্ক্ষা আর সম্ভোগের মোহ হাছন রাজাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আবার নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারেন। আর তখন তিনি সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন গানের মাধ্যমে। তিনি লিখেছেন, ‘যমের দূতে আসিয়া তোমার হাতে দিবে দড়ি/টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমেরও পুরি রে।’ আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মোপলব্ধির ভেতর দিয়েই হাছন রাজা মরমীসাধনলোকের সন্ধান পেয়েছিলেন।

জমিদার পুত্র হাসনরাজা নিজের জীবনে এই অনিত্য সংসার সম্পর্কে বুঝেছিলেন। ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে হাছন রাজা জন্মগ্রহণ করেন। হাছন রাজার কথা, হাছন রাজার গান ছোট বয়স থেকেই শুনে আসছি। প্রেম ও বৈরাগ্যময় আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর গানগুলি যেন হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের একটি মিলন ক্ষেত্র। তিনি গানের ভণিতায় নিজেকে ‘পাগলা হাসন রাজা’, ‘উদাসী’, ‘দেওয়ানা’, ‘বাউলা’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি কৈশোর ও যৌবনে শ্রীকৃষ্ণের নানাবিধ লীলায় অভিনয়ও করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও হাসন রাজা ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি সহজসরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় এক হাজার আধ্যাত্মিক গান রচনা করেন।

হাসন রাজা দেখতে সুদর্শন ছিলেন। মাজহারুদ্দীন ভূঁইয়া বলেন, ‘বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ে তেমনি সৌম্যদর্শন ছিলেন। চারি হাত উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ এবং একমাথা কবিচুল পারসিক সুফী কবিদের একখানা চেহারা চোখের সম্মুখে ভাসতো।’অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজসরল সুরে প্রায় সহগ্রাধিক মরমী গান রচনা করেন। প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষাকালে নৃত্যগীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগবিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এর মধ্যেই বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন, নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত। আশ্চর্যের বিষয় হল, এসব গানে জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে, ভোগবিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ১৭ বছর বয়সে হাসন রাজা রামপাশা আর লক্ষ্মণশ্রীর জমিদারি লাভ করেন। যৌবনের উন্মত্ততায় তিনি দলছুট ঘোড়ার মতো ছুটে গিয়েছিলেন নদীর কিনারেঘাটেহাটেমাঠে।

তাঁর গানের গভীর ও মায়াবি বাণী, আকুলব্যাকুল সুরমূর্ছনা সহজেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় শ্রোতার অন্তর। রাজা হয়েও তিনি ঋষি ছিলেন। তিনি প্রাচীন ঋষিদের মতো শব্দ নিয়ে খেলা করতেন। সে কারণে তাকে রাজর্ষি বলা যায়। তবে ঋষিদের শব্দব্রহ্ম ছিল মূলত ঈশ্বর ও অতীন্দ্রিয় জগৎ নিয়ে। হাছন রাজারও সে রকম ভাবনা ছিল। পাশাপাশি তার ভাবনা ছিল মানুষ, জীবন ও জগৎ নিয়ে। আর সেখানেই রয়েছে তার দার্শনিক পটভূমি। রাজর্ষি হাছনকে সেখানে দার্শনিক হাছন রাজা হিসেবেও বিচার করা যায়। তার গান বা কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে এই দর্শন। দরবেশী জীবন বরণ করে তিনি গ্রষ্টার প্রেমে মগ্ন হয়েছিলেন। এক সময়ের চণ্ড হাছনহয়ে গেলেন মানবিক ও নম্র হাছন। তাঁর গানে পরমের সঙ্গে মিলনের আকুতি, জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব, জগতের অনিত্যতা, সংসারাবদ্ধ ও প্রমোদমত্ত মানুষের সাধনভজনে অক্ষমতার খেদোক্তিই বেশ করেই প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন,‘বৃথা কাজে হাছন রাজায় দিন গুয়াইলাম/ ভবের কাজে মত্ত হইয়া দিন গেল গইয়া/ আপন কার্য না করিলাম, রহিলাম ভুলিয়া/ নাম লইব নাম লইব করিয়া আয়ু হইল শেষ।’

স্ত্রীপুত্র, আত্মীয় পরিজন নিয়ে যে সংসার সেই সংসারের মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে আমরা সবাই জড়িয়ে আছি। জমিদারি ও সংসারের মধ্যে থেকেও তিনি এক বিবাগী বাউল। কারও মতে হাসন ছিলেন সুফি বাদী। আবার কারো মতে চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। তিনি নিজেকে বাউলা বা বাউল বলেই দাবি করতেন। হাছন রাজার জীবনযাত্রা মোটেও বাউলদের মতো ছিল না। তিনি গৃহী ছিলেন। সংসারী ছিলেন। বৈষয়িক জ্ঞানও যে তার খুব কম ছিল সেটা বলা যাবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন বাউল। সহজসরল অনাড়ম্বর চলাফেরায় তিনি বাউলদের নৈকট্য অনুভব করতেন। সামন্তবাদী পারিবারিক বাউলদের জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। হাছন রাজার দৌহিত্র দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেছেন, বাউল ভাবনা থাকলেও হাছন রাজা বাউল ছিলেন না। কিন্তু বাউল দর্শন যে তাকে প্রভাবিত করেছিল সেটা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক
পরবর্তী নিবন্ধহালদার তীর থেকে রাজশাহীর মোহনপুর