ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নতুন করে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি বাহিনী তাদের বর্বরতা অব্যাহত রেখেছে। এবারের হামলার ভয়াবহতা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, এ দফায় বিশ্ব এগিয়ে না এলে তাদের বাঁচার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। জাতিসংঘের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এর ভয়াবহতা উঠে এসেছে।
এ গণহত্যা বন্ধের দাবিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল করেছে হাজার হাজার মানুষ। তারা গাজায় বর্বর হামলা এবং ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের নিন্দা জানিয়েছেন। এছাড়া অবিলম্বে গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ এবং সেখানে ত্রাণ ও মানবিক সহায়তার প্রবাহ স্বাভাবিক করার দাবি জানাচ্ছেন। প্রতিদিন সংবাদপত্রে উঠে এসেছে গণহত্যার এ বর্বর চিত্র।
এদিকে ফিলিস্তিনের গাজায় ‘ত্রাণ ফুরিয়ে গেছে ও ভয়াবহতার দুয়ার আবার খুলেছে’ বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। উপত্যকাটিতে ত্রাণ ও সব ধরনের পণ্য সরবরাহের প্রবেশ আটকে দিয়েছে ও সমপ্রতি সেখানে নতুন করে বেপরোয়া হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস গত মঙ্গলবার বলেন, ‘গাজা মানুষ হত্যার একটা ক্ষেত্র (হয়ে উঠেছে) ও সেখানকার বেসামরিক লোকজন এক অন্তহীন মৃত্যুফাঁদে আটকে পড়েছেন।’
গুতেরেসের এ মন্তব্যের আগে জাতিসংঘের ছয়টি সংস্থার প্রধান ফিলিস্তিনিদের কাছে জরুরি ভিত্তিতে খাবার ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জোর দিয়ে বলেছে, গাজায় যথেষ্ট খাবার রয়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গুতেরেস কুৎসা রটাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
উল্লেখের দাবি রাখে যে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের প্রথম দফার যুদ্ধবিরতির মেয়াদ গত ২ মার্চ শেষ হয়। এর পর থেকে দেশটি আবারও গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে এবং সেখানে নতুন করে নির্বিচার হামলা ও বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। হামাস যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, ইসরায়েল তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে।
১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েলের নতুন করে শুরু করা বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সেখানকার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েলের হামলায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৬৯৫ জনে। তবে ইসরায়েল জোর দিয়ে বলছে, তারা কোনো বেসামরিক লোকজনকে নিশানা করে না।
আন্তোনিও গুতেরেস গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীন গাজার জনগণের কাছে খাবার ও চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছানো নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা দখলদার শক্তির (ইসরায়েল) রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে সে পথ বন্ধ। আন্তর্জাতিক আইন ও ইতিহাসের চোখে এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ গুতেরেসের মন্তব্যের আগে গত সোমবার এক যৌথ বিবৃতি দেয় জাতিসংঘের ছয়টি সংস্থা। বিবৃতিতে তারা ফিলিস্তিনিদের কাছে খাবার ও ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিশ্বনেতাদের অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে কাজ করতে হবে বলে উল্লেখ করে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘গাজার বাসিন্দারা আবার ফাঁদে আটকে পড়েছেন এবং বোমা হামলা ও ক্ষুধার শিকার হচ্ছেন। গাজার সব বাসিন্দাকে খাওয়ানোর মতো এখন যথেষ্ট খাদ্য নেই এবং অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ফুরিয়ে আসছে।’ বিবৃতিতে যেসব সংস্থার প্রধানেরা সই করেছেন, সেসব হলো ওসিএইচএ, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও, ইউএনআরডব্লিউএ, ইউএনওপিএস।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘গাজা একটি অবরুদ্ধ ভূখণ্ড। যেখানে ২০ লাখের বেশি মানুষ সীমিত সম্পদ ও সুযোগ–সুবিধা নিয়ে বেঁচে আছে। এখানে বরাবরই ইসরায়েলের সামরিক অভিযানগুলো অমানবিক বলে সমালোচিত। স্কুল, হাসপাতাল এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রেও হামলা হয়, হচ্ছে। এসব হামলায় শিশু ও নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু শুধু পরিসংখ্যান নয়, একটি জাতির ভবিষ্যৎ ও স্বপ্ন ধ্বংসের প্রতিচ্ছবি।
ইসরায়েল দাবি করে, তারা হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো লক্ষ্য করে এসব অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু বারবার বেসামরিক মানুষের ওপর ভয়াবহ হামলা তাদের এ দাবির ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাস্তবে টার্গেট হচ্ছে হামাস নয়, সাধারণ নিরীহ মানুষ। আসলে দীর্ঘদিন ধরে এ মর্মান্তিক বাস্তবতা স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সংঘাত শুধু একটি ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি উপেক্ষার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এ অব্যাহত আগ্রাসন কেবল ফিলিস্তিনিদের জীবন ধ্বংস করছে না, বরং বিশ্ব সমপ্রদায়ের নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের প্রতিও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে।’ জাতিসংঘ যেভাবে ভূমিকা পালন করছে, অন্যদেশগুলোকে তা অবলম্বন করতে হবে। বিশ্বের সবাইকে এ অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।