পর্ব ২
অয়োময় গল্পটি বিপুল সাড়া ফেলেছিল বোদ্ধামহলে। এছাড়া অয়োময় ধারাবাহিক নাটকটি নব্বই দশকে দেশজুড়ে দর্শকদের মাঝে দারুণ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। নাটকটি ছিল হুমায়ূন আহমেদ রচিত এবং নওয়াজীশ আলী খান পরিচালিত। এর গল্পটি একটি ক্ষয়িষ্ণু বাংলা জমিদার (ভূস্বামী) পরিবারকে কেন্দ্র করে। উল্লেখ্য, অয়োময় বইটি প্রকাশ করা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের সাতটি গল্পের সংকলন হিসেবে। যে সাতটি ছোট গল্প আছে তা হচ্ছে–
এক. অয়োময়
বদরুল আলম সাহেব তার গ্রামের বাড়ির বাংলাঘরে ইউনুস নামের এক অসুস্থ লোককে থাকতে দেন। ডাক্তার বলেছে ইউনুসের যে পচন রোগ তাতে সে দুই দিনের মধ্যে মারা যাবে। কিন্তু তেরো চৌদ্দ দিনেও ইউনুস মারা যায় না। মাওলানা দিয়ে তওবা পড়ানো হয়, কিন্তু ইউনুস ঠিকমত তওবা পড়ে না, তার আরো বেঁচে থাকার ইচ্ছে। শেষে বদরুল আলমকে ইউনুস বলে সে মরতে চায় না। বদরুল আলম ইউনুসকে ময়মনসিংহ নিয়ে যান চিকিৎসার জন্য।
দুই. খাদক
খাদক মতি। খাদক হিসেবে মতির রয়েছে বেশ নামডাক। এক বৈঠকে আধামণ গোশত খেতে পারে। গ্রামে দারুণ সাড়া পড়ে গেল। খোন্দকার সাহেব একটা গরু জবাইয়ের ব্যবস্থা করলেন। খোন্দকার সাহেব বললেন, মতি আস্ত গরু খেতে পারবি? বিশিষ্ট মেহমান আছে। তাঁর সামনে একটা রেকর্ড হয়। ঢাকায় ফিরে উনি কাগজে লিখে দেবেন। রান্নার আয়োজন চলছে। মতি মিয়া বসে আছে হাসিমুখে। মাঝে মাঝে বিড়ি খাবার জন্যে বারান্দায় উঠে যাচ্ছে আবার এসে বসছে। মতি মিয়া খাওয়ার টেকনিকের কথা বেশ উৎসাহের সঙ্গে বলল গোশত চিপা দিয়া রস ফেলাইয়া দিতে হয়। কিছুক্ষণ পর পর একটু কাঁচা লবণ মুখে দিতে হয়। পানি খাওয়া নিষেধ।
আর চাবাইতে হয় খুব ভাল কইরা। গোশত যখন মুখের মধ্যে তুলার মত হয় তখন গিলতে হয়।
বসারও কায়দা আছে। বসতে হয় সিধা হইয়া যেন পেটের উপর চাপ না পড়ে।
তিন. অচিন বৃক্ষ
লেখক গহিন গ্রামে যান অলস সময় কাটাতে, কিন্তু গ্রামের লোকের জোরাজুরিতে এক দুর্গম পাড়া গায়ে যেতে হয় একটি অচিনবৃক্ষ দেখতে। হাজার বছর আগে নাকি এক ডাইনি এই গাছে চড়ে যাচ্ছিলো। এখানে এসে তার পিপাসা পেলে গ্রামের মিঠাপানি পান করে সন্তুষ্ট হয়ে এই গাছটি দিয়ে যান। গাছের ফুল অনেক বছর পরে ফুটবে বলে যায় ডাইনি। সেই ফুল সর্ব রোগের ঔষধ। গ্রামের হেড মাস্টার সাহেব অপেক্ষা করে আছেন সেই ফুলের জন্য। কারণ তার স্ত্রী মৃত্যুর সাথে লড়ছে।
চার. পিঁপড়া
মকবুল নামে এক রোগী এসেছে ঢাকার বড় ডাক্তারের কাছে। তার সমস্যা হচ্ছে তাকে পিঁপড়ায় কামরায়। সে যেখানেই যান পিঁপড়া তার পিছু পিছু যায়। এমনকি নদীর মাঝখানে নৌকাতেও তাকে রেহায় দেয় না।
পাঁচ. অপেক্ষা
চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে সেই ছোট বেলা থেকে কাজ করে কেরামত। এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। সে এসে চেয়ারম্যান সাহেবকে বলে বিয়ে করতে চায়। চেয়ারম্যান সাহেব বলেন তিনি নিজে ওর ঘর তুলে দিয়ে বিয়ে দিবেন। কিন্তু এর মধ্যে চেয়ারম্যানের দিন খারাপ হয়ে যায়। কেরামত ঘরও হয় না আর বিয়েও হয় না। কেরামত অপেক্ষা করতে থাকে।
ছয়. কৃষ্ণপক্ষ
হানিফ এসেছে রইসুদ্দিন নামের এক লোককে খুন করতে। খুনটা করতে পারলে পাঁচ হাজার টাকা পাবে। কৃষ্ণপক্ষের রাতে সে অপেক্ষা করে আছে রইসউদ্দিনের আসার।
সাত. অংক শ্লোক
গ্রামের এক পাগলা মাস্টার ছাত্রদের অংক ভীতি দূর করার জন্য অংক শ্লোক লিখছেন, সেটি বই আকারে ছাপাতে চান। তার একমাত্র মৃত কন্যার ছিল প্রচন্ড অংক ভীতি।
আনন্দ বেদনার কাব্যতে নয়টি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পটি পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছিল ব্যাপকভাবে।
প্রথম গল্প : আনন্দ বেদনার কাব্য
‘রিক্তশ্রী পৃথিবী’ নামক একটি কাব্যগ্রন্থ পড়ার সময় লেখকের অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে গল্পে। ১১৩টি কাব্য ছিলো সেই গ্রন্থে। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছে গ্রন্থাকারের স্কুল পড়ুয়া মেয়ে। বইটি লেখার পাঁচ বছর পরে যখন বইটি ছাপা হয় তখন লেখকের সেই প্রচ্ছদ শিল্পী মেয়ে আর বেঁচে নেই।
দ্বিতীয় গল্প : এইসব দিন রাত্রি
এইসব দিনরাত্রি একটি একান্নবর্তী পরিবারের সুখ–দুঃখের গল্প। আশা ও আনন্দের, ব্যর্থতা ও বঞ্চনার গল্প। কিছু সাধারণ মানুষের সাধারণ কিছু স্বপ্নের গল্প। ম্যাজিশিয়ান আনিস স্বপ্ন দেখে একটি কিশোরীর, রফিক স্বপ্ন দেখেন সুখী নীলগঞ্জের।
প্রসঙ্গত, এইসব দিনরাত্রি ১৯৮৫ সালে বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত একটি জনপ্রিয় পারিবারিক নাটক। নাটকটা সেই সময় এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে নাটক চলাকালে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাগুলো ফাঁকা থাকত। নাটকটি ঢাকা শহরে বসবাসকারী একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প বলে। নাটকটিতে একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ, ভালোবাসা, বিয়ে, মৃত্যু, সমস্যা ইত্যাদিই দেখানো হয়েছে।
তৃতীয় গল্প : ঊনিশ শ একাত্তর
গ্রামে হঠাৎ করেই এসে পরে একদল পাকিস্তানি মিলিটারি, সবাই ভয়ে পালিয়ে যায় বনে। একটি পাগল কিন্তু পালায় না। পাগলকে গাছের সাথে বেঁধে রেখে তারা সেখানে বিশ্রাম নিতে বসে। গ্রামের মুরব্বীদের অনুরোধে ভীতু এক প্রাইমারি মাস্টার দেখা করতে আসে মিলিটারির সাথে। তাকে চরম অপমান করা হয়। শেষে ভীতু সেই মাস্টার মিলিটারি অফিসারের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
চতুর্থ গল্প : জল ছবি
জলিল সাহেব প্রতিদিনই ঠিক সময়ে অফিসে আসেন, কখনো দেরি হয় না। আজ অফিসে আসার সময় হঠাৎ জুতাটা ছিঁড়ে গেলো। সেটা ঠিক করতে দেরি হয়ে গেলো অফিসে আসতে। অফিসে এসে শুনলেন তাকে বড় সাহেব খুঁজেছেন। জলিল সাহেবের ইমিডিয়েট বস তাকে কোনো কারণে অপছন্দ করেন, অকারণে তার খুঁত ধরেন। সারা দিন তিনি ভয়ে ভয়ে কাটালেন দুপুরের দিকে আবার তার ডাক পড়লো বড় সাহেবের ঘরে। ভয়ে ভয়ে দেখা করতে গেলেন তিনি। তখন শুনলেন হেড অফিস তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অফিসার পদে প্রমোশন দিয়েছে। খবরটা শুনে তিনি বিষয়টা ঠিক ধাতস্থ করতে পারলেন না।
পঞ্চম গল্প : খেলা
নলিনী বাবু একটি স্কুলে ইংরেজি পড়ান তার বন্ধু জালাল সাহেবের পাল্লায় পড়ে দাবা খেলা শিখে ফেলেন। শিখেই তিনি তার বন্ধুকে খেলায় হারিয়ে দেন, একের পর এক কয়েকটি গেম খেলা হলেও তিনি প্রতিটা খেলাতে জিতে যান। এরপর পনেরো বছর কেটে যায়, তিনি পনেরো বছরে কোনো দাবা খেলায় হারেন নাই। সারা শহরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি শালির বাড়িতে বেড়াতে এসে বাংলাদেশের দাবা চ্যাম্পিয়ন তার সাথে দাবা খেলেন, নলিনী বাবু তাকে তিনবার হারান। নানান জায়গা থেকে অনেক লোক খেলতে এসে হেরেছেন। পনেরো বছরে দরিদ্র মাস্টার নলিনী বাবুর শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়লো। তখন তার চাকরির অবসর সময়ে এলাকার চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন নলিনী বাবুকে যে হারাতে পারবে তাকে পনেরো হাজার টাকা পুরস্কার দিবেন। নলিনী বাবুর চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। তাই তখন ঠিক করা হয় তিনি জীবনে প্রথমবার হারবেন তার বন্ধু জালাল সাহেবের কাছে। জেতার পনেরো হাজার টাকা দিয়ে তার চিকিৎসা করা হবে। কিন্তু তিনি চেষ্টা করেও জীবনের শেষ খেলায় হারতে পারেন নাই। ঠিকই জিতে গেলেন।
ষষ্ঠ গল্প : শিকার
আজরফ বক শিকার করে। তার বাবাও বক শিকার করতো। প্রথমে ছোট একটা বকের ছানা এনে পেলে পুষে সেটাকে বড় করে, তার পর সেই বককে দিয়ে মাচা বানিয়ে সেখানে বসিয়ে রেখে নিজে মাচার নিচে বসে থেকে ফাঁদ পাতে। পোষা বকের ডাকে যখন অন্য কোনো বক সেই মাচায় এসে বসে তখন নিচ থেকে সেই বকের পা ধরে টানদিয়ে নিচে নামিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু কখনো কখনো বকেরা শিকারির চোখে ঠোকর দিয়ে তাকে অন্ধ করে দেয়। আজরফের বাবারও দুটি চোখই এভাবে নষ্ট হয়েছে, এবার ওর নিজের পালা।
সপ্তম গল্প : পাখির পালক
একজন বেকার যুবকের সারাদিনের এলোমেলো উদ্দেশ্যহীন কিছু কর্মকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে এই গল্পে।
অষ্টম গল্প : অসুখ
একজন অপ্রকৃতস্থ মা যার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাকে মাঠের মাঝে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। এই কথা মনে হলেই মা আরো অপ্রকৃতস্থ হয়ে যান। তাই যুদ্ধে ছেলের সাথে থাকা বন্ধু মাঝে মাঝে এসে বলে যায় তার ছেলেকে জবাই করা হয়নি, তার পেটে গুলি লেগে মারা যায়। এ কথা শুনে মা কিছু দিনের জন্য শান্ত হয়।
নবম গল্প : কবি
মা হারা অসুস্থ এক ছোট্ট মেয়ে আর তার কবি বাবা, বৃষ্টির রাতে লিখে চলে চোখে জল নিয়ে নতুন কোনো কবিতা।
nooruddin.cu@gmail.com