প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে বুধবার গভীর রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে পুড়ে গেছে অনেক নথি। ভবনের ৬, ৭, ৮, ৯ এই চারটি তলা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার মধ্যে অষ্টম ও নবম তলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি। সেখানকার অধিকাংশ নথি পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের চেষ্টায় ১০ ঘণ্টা পর সেই আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়। দেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে এত বড় আগুনের ঘটনা কীভাবে ঘটলো, এটা নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা? এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলসহ সাধারণ মানুষের মাঝেও আলোচনা, কৌতূহল ও প্রশ্ন রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল গতকাল সকালে বলেন, রাত ১টা ৫২ মিনিটে আমরা মেসেজ পাই সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লেগেছে। ১টা ৫৪ মিনিটের মধ্যে আমাদের ইউনিট পৌঁছে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। বৃহস্পতিবার (গতকাল) সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে আমরা শত শত পুড়ে যাওয়া নথি দেখতে পাই। এক স্থানে বেশ কিছু মৃত কবুতর ও একটি কুকুর পেয়েছি; যেগুলো ওখানে থাকতো। ফায়ার সার্ভিসের আরেক কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, সাত নম্বর ভবনের সপ্তম কিংবা অষ্টমতলা থেকে আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি কুকুরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পুড়ে গেছে ও ফুলে ছিল মৃত কুকুরটি।
জানা যায়, সচিবালয়ে আটটি ভবনে ৩০টি মন্ত্রণালয়ের দপ্তর রয়েছে। বুধবার গভীর রাতে ৭ নম্বর ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়। দশ তলা ওই ভবনেই অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ; পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর।
রাতে আগুন লাগার পর কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় পুরো সচিবালয় এলাকা। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরাও পরে আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সঙ্গে যোগ দেন। অগ্নি নির্বাপণের কাজে পানির লাইন দিতে গিয়ে সচিবালয়ের সামনের রাস্তায় ট্রাক চাপায় আহত হন মো. সোহানুর জামান নয়ন নামের একজন ফায়ার ফাইটার। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিসের ডিজি জানান, ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়িগুলো ঢোকাতে না পারায় কাজে বেগ পেতে হয়েছে। সচিবালয়ের সামনের গেইট ভেঙে দুটো গাড়ি ঢুকিয়েছি। রাতে ঘটনাস্থলের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনের কলাপসিবল গেইট কেটে ভেতরে ঢুকে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। ভবনের সিঁড়িতে হোস পাইপ থেকে ছোড়া পানির স্রোত বইছে। সকালে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ফায়ার সার্ভিসের ডিজি বলেন, বর্তমানে ফায়ার ফাইটাররা দালানের ভেতরে কাজ করছে। প্রতিটি কক্ষ তল্লাশি করে আগুন নেভাচ্ছে। নেভানোর কাজ প্রায় শেষের দিকে। এ পর্যন্ত ২১১ জন জনবল কাজে নিয়োজিত হয়েছে।
রাতে অগ্নিকাণ্ডের সময় দশ তলা ওই ভবনের উপরের দিকের একটি ফ্লোর এমাথা–ওমাথা জ্বলতে দেখা যায়। এ অগ্নিকাণ্ডের কারণে নিয়ে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন সন্দেহ প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় গভীর রাতে আগুন লাগার কারণ নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন সন্দেহের কথা বলেন। আগের সরকারের দুর্নীতির প্রমাণ নষ্ট করতে আগুন লাগানো হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ। সব বিবেচনায় তারা এটাকে অগ্নিকাণ্ড না বলে বলছেন নাশকতা।
এদিকে সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণ ও উৎস খুঁজে বের করতে জ্যেষ্ঠ সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। এই কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ কথা জানান। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে এদিন একটি জরুরি বৈঠকে উচ্চ পর্যায়ের এই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এই কমিটির সভাপতির দায়িত্বপালন করবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। সদস্য হিসেবে থাকবেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, পুলিশের আইজিপি, ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (সদস্য সচিব), সদস্য সশস্ত্র বাহিনীর একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েট থেকে ৩ জন বিশেষজ্ঞ, একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, একজন কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, এই কমিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ, উৎস এগুলো খুঁজে বের করে আগামী তিন দিনের মধ্যে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট সরকারকে দেবে। প্রাথমিক প্রতিবেদনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানানো না গেলেও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে পুরোটাই জানানো হবে। এবং যতদ্রুত সম্ভব এই প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
অন্যদের মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বৃহস্পতিবার সকালে এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থলোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এখনো জানা যায়নি। আমাদেরকে ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে, তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।
উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সাত সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করেছে। অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন) মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহ্বায়ক করে গঠিত এই কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অফিস আদেশে বলা হয়েছে, সংঘঠিত অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ উদঘাটন, পেছনে কারো ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায় আছে কিনা তা উদঘাটন এবং এ জাতীয় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তদন্ত কমিটিকে।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে ৭ নম্বর ভবনের প্রতিটি দপ্তরের সিসিটিভি ভিডিও সংগ্রহ করার কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম। এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভেতরে থাকা সিসি ক্যামেরার ভিডিও এরই মধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে ভিডিওতে অগ্নিকাণ্ডের কারণ বোঝা গেছে কি না, তা স্পষ্ট করেননি জাহাঙ্গীর আলম। সাংবাদিকদের তিনি তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলেছেন। প্রতিটি দপ্তরেই সিসি ক্যামেরা রয়েছে বলে সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, একজন করে এসপি ও এএসপিসহ আইনশৃক্সখলা বাহিনীর ৫৬০ জনের মত সদস্য সচিবালয়ের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করেন।
সচিবালয়ের আগে সচিব নিবাসেও আগুন লাগে : বাংলা নিউজ জানায়, বুধবার রাতে ঢাকায় আরেকটি আগুনের ঘটনাও ঘটেছে। সেটি ঘটে রাজধানীর ইস্কাটন এলাকায় সচিব নিবাসে। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। গতকাল বৃহস্পতিবার ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসীম এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, বুধবার রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে আমাদের কাছে সংবাদ আসে ইস্কাটন গার্ডেন রোডে অবস্থিত সচিব নিবাসের ২০ তলা ভবনের চারতলার একটি বাসার রান্নাঘরে আগুন লেগেছে। পরে ঘটনাস্থলে সিদ্দিক বাজার ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি। এছাড়া এ আগুনে কেউ হতাহত হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত দপ্তরের কাজ যেভাবে চলবে : সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে লাগা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম চলমান রাখতে অন্যান্য সরকারি দপ্তরে খালি জায়গা খোঁজার কথা বলেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য, কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য অন্যান্য সরকারি দপ্তর যেখানে জায়গা খালি আছে, সেই জায়গাগুলোতে রিলোকেট করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এরই মধ্যে কোথায় কোথায় খালি আছে, কোথায় কোথায় মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম আপাতত অস্থায়ীভাবে পরিচালনা করা যায়।