গণহত্যার আর্তনাদে হত্যাকারীদের আত্মহত্যা

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ২৬ অক্টোবর, ২০২৪ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

কী নির্মম ইতিহাসের বিষাদময় উপাখ্যান বিশ্ববাসী অবলোকন করছে, তার সঠিক উপলব্ধি বিশদ বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ক্ষমতাধর পরাশক্তির মানুষ হত্যার নানামুখী নির্মম অভিযান সভ্যসমাজের বুকে গভীর ক্ষত তৈরি করেই চলছে। মারাত্মক অস্ত্রের ব্যবহার সামগ্রিকভাবে মানুষ ও ধন সম্পদের বিধ্বংসী অধ্যায় রচনা করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সর্বনিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপনে ইসরায়েলের বেপরোয়া অভিপ্রায় অবাক বিস্ময়ে বিশ্ব তাকিয়ে আছে। আরব বিশ্বসহ সমুদয় উন্নতঅনুন্নত দেশের সরকারগুলোর বিরুদ্ধে জোরালো কন্ঠস্বর তেমন উচ্চকিত নয়। সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে রহস্যপূর্ণ কারণে সকলে প্রায় নির্বিকার। মুখে কুলুপ এঁটে নীরব দর্শকের ভূমিকায় স্ব স্ব স্বার্থে তাদের অবস্থান সুদৃঢ়। অতিসম্প্রতি গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গাজা ও লেবাননে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনায় ইসরায়েলি সেনারা বিবেক বোধের তাড়নায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। নির্বিচারে অপরিসীম দমনপীড়ননিপীড়নগোলা ও গুলি বর্ষণে নারীশিশু নির্বিশেষে মানব হত্যার অমানবিক দৃশ্যাদৃশ্য সেনাদের আক্রান্ত করছে। ইসরায়েলের প্রভাবশালী পত্রিকা হারেৎজের প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১১ মে পর্যন্ত ১০ জন ইসরায়েলি সেনা আত্মহত্যা করে। তাছাড়া টাইমস অব ইসরায়েলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ইসরায়েলি সেনাদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল আত্মহত্যা। সে বছরেই প্রায় ১১ সেনা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল।

এটি সমগ্র বিশ্বের জন্য নতুন উদাহরণ তৈরি করলেও হিংস্র পশুতুল্য দানবদের কোন ভাবেই নমনীয় করা যাচ্ছে না। সহজসরলনিরীহ স্বাধীনতাকামী মানুষদের অধিকার হরণে এমন নির্মমতানিষ্ঠুরতাসহিংসতা মানব সমাজ প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছে। প্রায় প্রত্যেক দেশেই এমনকি ইসরায়েলেও সাধারণ মানুষ বজ্রকন্ঠে প্রতিবাদ জানালেও সরকার সমূহের অপকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারছে না। তাহলে কী ধরে নিতে হবে যে সত্যসুন্দরকল্যাণআনন্দ প্রতিষ্ঠার মানবিকতা বিলুপ্তির পথে? সমাজসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় চড়াইউৎরাই এর লব্ধ অভিজ্ঞতায় আধুনিক বিশ্বের চলমান পর্যায়। সৃজনমননশীলতা, নান্দনিকতা, মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ, সৌহার্দসম্প্রীতির অটুট বন্ধনে বর্তমান বিশ্ব অধিকতর এগিয়ে চলার পথে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা রোবটিক প্রযুক্তির শীর্ষ উন্নয়নের পরিক্রমায় বর্তমান সময়ে এ ধরনের বিকলাঙ্গ চরিত্র সমাজ কী ধারণ করতে পারছে? বিশ্বজনীন ভাতৃত্ববন্ধুত্বপারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি যে ঐতিহ্যের উপমা হয়েছে তা কী অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে?

সম্প্রতি লেবানন কেন্দ্রীক ইসরাইলি হামলা আরেক নির্দয় পরিশিষ্ট সংযোজিত করছে। লেবাননে ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরুর পর থেকে ঐ এলাকায় ১০ হাজার ৪১৫ বার হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। বিশেষ করে দক্ষিণ লেবাননে হামলার তীব্রতা অত্যধিক। ইসরায়েলহিজবুল্লাহ সংঘাতে লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত নিহত হয়েছে ২ হাজার ৪৪৮ জন। আহতের সংখ্যা ১১ হাজার ৪৭১ জন। লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ঘাঁটিতেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। উল্লেখ্য যে, গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজায় হামাসইসরায়েল সংঘাতের সমর্থনে ৮ অক্টোবর ইসরায়েলের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকে হিজবুল্লাহ। যদিও ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে প্রায় ৪০ বছর ধরে চলমান। যার সূত্রপাত হয় ১৯৮২ সালে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল কর্তৃক লেবানন আক্রমণের সময়। এই আক্রমণের প্রেক্ষিতে লেবাননের শিয়া সম্প্রদায়ের নেতারা ইরানের সহায়তায় হিজবুল্লাহ গঠন করে। তাদের মূল্য লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের উপস্থিতি প্রতিহত করা।

আমাদের সকলের জানা, গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ ফিলিস্তিনের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘকাল ধরে পরিচালিত যুদ্ধের অংশ হিসেবে হামাসের ইসরাইল আক্রমণকে কেন্দ্র করে ইসরাইলের পক্ষ থেকে গাজা ও পশ্চিম তীরে নৃশংসতম হত্যাগণহত্যার দৃশ্যাদৃশ্য ভয়ঙ্কররূপ পরিগ্রহ করেছে। বিশ্বের কতিপয় ক্ষমতাধর কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রনায়কের প্রত্যক্ষ মদদ ও আধুনিক সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখে নারকীয় তান্ডবের নজিরবিহীন দৃশ্যপট তৈরি করে চলছে। সমগ্র ধরিত্রী অবাক বিস্ময়ে এহেন বর্বর কর্মযজ্ঞ শুধু পর্যবেক্ষণ করছে না; তীব্র ঘৃণা ও নিন্দার সাথে ইসরাইলি কদর্য অপকৌশল প্রত্যাখান করছে। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন থামার কোনো লক্ষণ এখনও দৃশ্যমান নয়। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাজুড়ে নির্বিচারে বিমানরকেটবোমা হামলা চলমান রেখেছে দখলদার ইসরাইল বাহিনী। জাতিসংঘের সাধরণ পরিষদে গাজায় ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’ প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হলেও; আগের তুলনায় ব্যাপক বোমা হামলা বাড়িয়েছে ইসরাইল।

বিশ্বনেতৃবৃন্দের যুদ্ধবিরতির জোরালো আহ্বানকে উপেক্ষা করে ‘জয়ী’ না হওয়া পর্যন্ত এমন হামলা চলতে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী। অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় এমন কোনো স্থান নেই যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালায়নি। ১৯৪৮ সাল থেকে নির্যাতিতনিপীড়িত ফিলিস্তিনিরা যুগের পর যুগ চরম অবিচারের সম্মুখীন। দেশ থেকে জোরপূর্বক বিতাড়নের মাধ্যমে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল যে দখলদারিত্ব শুরু করেছিল; তা রোধে আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত নয়। ধারাবাহিক এ সংঘাতে নিরীহ মানুষের প্রাণহানির সঠিক পরিসংখ্যান বের করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। একটি স্বাধীনসার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এ সমস্যার একমাত্র ন্যায়সংগত সমাধান হলেও; ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার্থে বা পক্ষপাততুষ্ট আচরণের কারণে কিংবা নতুন নতুন সংকটে এ বিষয়ে তথাকথিত উন্নতক্ষমতাধর রাষ্ট্রের নানা রকম উদ্যোগপ্রতিশ্রুতি বারংবার ব্যর্থই হয়েছে। গাজার উত্তরাঞ্চলে কয়েকদিন ধরে নতুন করে নৃশংসতা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এতে বিপুল সংখ্যক নিরীহ মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে।

২২ অক্টোবর ২০২৪ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় প্রকাশিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের তথ্যসূত্রে জানা যায়, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলায় এ পর্যন্ত ৪২ হাজার ৭১৮ জন নিহত এবং ১ লাখ ২৮২ জন আহত হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গাজা উপত্যকার ধ্বংসস্তুপের নিচে এখনও ১০ হাজারের বেশি মানুষ আটকা পড়ে আছে। ফিলিস্তিনি নাগরিকদের উদ্বারের জন্য ইসরায়েলি বাহিনী উদ্ধারকারী দলকে সেখানে পৌঁছাতে বাধা প্রদান করছে। ফলশ্রুতিতে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলি আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তচ্যুত হয়েছেন। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সংকটে গাজার সবাই এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থায় নিপতিত। আসন্ন শীতকালে গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা। তাদের মতে, উপত্যকাটিতে অন্তত ১৮ লাখ মানুষ চরম খাদ্য সংকটে ভুগছে। ফিলিস্তিনে নিযুক্ত জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউর বক্তব্যে উপস্থাপিত যে, খাদ্যের অভাবে গাজার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়াদের নানা রোগ দেখা দিচ্ছে। যা উপত্যকার মানবিক সংকটকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষ এড়াতে অবরুদ্ধ গাজায় দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ চালু নিগূঢ় প্রত্যাশিত।

বার্তা সংস্থা এপির ভাষ্য, খাদ্য সহায়তা আটকে দিয়ে উত্তর গাজাকে জনশূন্য করার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসরায়েলের মিত্র দেশ খোদ যুক্তরাষ্ট্র। গাজায় মানবিক সহায়তা না বাড়ালে ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা বন্ধের হুমকি দিয়েছে দেশটি। ইসরায়েলি সরকারের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো বার্তায় বলা হয়, ত্রাণ সরবরাহ বৃদ্ধি করতে ৩০ দিনের মধ্যে ইসরায়েলকে অবশ্যই ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এর অন্যথা হলে মার্কিন নীতিতে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়াও গাজায় গণহত্যা লেবাননইরানের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে ইসারায়েলের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক ক্রমশই অবনতির দিকে যাচ্ছে। অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে দেশটির কিছু উগ্র নেতার উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া আরম্ভ করেছে ইউভুক্ত দেশগুলো। হত্যাগণহত্যার চিত্রপট এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে; যাতে শুধু ইসরায়েল নয় বিশ্বের সকল সচেতন গোষ্ঠী মানসিক ট্রমায় প্রচন্ড বিপদগ্রস্ত। অচিরেই ক্ষমতাধর রাষ্ট্রসমূহের যুদ্ধ বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যথায় পুরোবিশ্ব ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে এগুনোর আশংকা তীব্র হওয়ার পথেই রয়েছে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজঅপরাধবিজ্ঞানী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবদুল হক চৌধুরীর কৃতি ও কীর্তি
পরবর্তী নিবন্ধবেশি মূল্যে পণ্য বিক্রি, ৪ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা