গণমাধ্যমের সুরক্ষায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক

নোয়াব ও সম্পাদক পরিষদের যৌথ প্রতিবাদ সভা

| মঙ্গলবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে যারা ‘মবের’ নামে নৈরাজ্য করছে, তাদের ঠেকাতে সরকার কেন তৎপর হয় না, সেই প্রশ্ন তোলা হল এক প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে। সেখানে স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার জন্য ‘ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের’ ডাক দিলেন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, ব্যবসায়ী, নাগরিক ও পেশাজীবী সমাজের প্রতিনিধিরা। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদপত্রের মালিক ও সম্পাদকদের দুটি সংগঠন নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশনোয়াব ও সম্পাদক পরিষদ সোমবার ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শিরোনামে এই যৌথ প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। খবর বিডিনিউজের।

ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এ প্রতিবাদ সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সংবাদপত্রের ওপর হামলা গণতন্ত্র ও জুলাই বিপ্লবের ওপর আঘাত। এখন শুধু সচেতন হলে চলবে না, অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমি জানি না, আমরা এই মুহূর্তে কোন বাংলাদেশে আছি। সারাজীবন সংগ্রাম করেছি একটা স্বাধীনসার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য। আজ যে বাংলাদেশ দেখছি, এই বাংলাদেশের স্বপ্ন আমি কোনো দিন দেখিনি।’

গণমাধ্যমে হামলা ও অগ্নিসংযোগে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় প্রতিবাদ সভায়। গত বৃহস্পতিবার হামলার ঘটনার প্রসঙ্গ ধরে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমার প্রায় ২৫২৬ জন সহকর্মী ছাদে আটকে ছিল, ফায়ার ব্রিগেডকে আসতে দেওয়া হয়নি। এটার মানে কী? তারাতো শুধু ভবন পোড়াতে চায়নি, তারা ডেইলি স্টারের কর্মীদের হত্যা করতে চেয়েছিল। মত প্রকাশ তো অনেক দূর হয়ে গেছে, এখন বেঁচে থাকার ব্যাপার এসে গেছে। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি, আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাষ্ট্রকাঠামোর অভ্যন্তরে ‘মবতন্ত্র’ শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রকাঠামোর দায়িত্বে যারা অধিষ্ঠিত, তারা মব ভায়োলেন্সের পেছনের শক্তিকে তাদের ক্ষমতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করেন।’ তিনি বলেন, ‘আজকে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের সকলের, দেশবাসীর দায় এটা প্রতিহত করা, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মূল দায়িত্ব সরকারের।’ দেশের মানুষের নিরাপত্তায় সরকার কী করছে, সে প্রশ্নের উত্তর সরকারকে দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অন্তর্বর্তী সরকারের নিষ্‌ক্িরয়তার সমালোচনা করে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই ঘটনা যে ঘটতে পারে, তার জন্য জনমানুষের পক্ষ থেকে কিন্তু ইংগিত সংকেত বিভিন্ন সময়ে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ সকলে মিলে করেছে। এ ব্যাপারে সকলের ঐকমত্য আছে। যদি একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব নিতে হয়, তাহলে এই বর্তমান সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের মনে রাখা উচিত, তারা কোনো নির্বাচিত সরকার না। বৈধ সরকার হয়ত, কিন্তু তারা নির্বাচিত সরকার না। একটি অনির্বাচিত সরকারের শাসন করার যোগ্যতা ক্ষমতা থাকে ততক্ষণ, যখন তার নৈতিক বৈধতা থাকে। এই ঘটনবার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার তার নৈতিক বৈধতা অনেক ক্ষেত্রেই হ্রাস করে ফেলেছে।’

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সরকারের রহস্যজনক নীরবতার জবাব আমাদের দিতে হবে। বিচার যদি করতে না পারেন, আপনাদের ব্যর্থতাই আমাদের রায় হবে।’

জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। পুরো পরিস্থিতির সঙ্গে জুলাই গণ অভ্যুত্থান ও পরবর্তীতে আমাদের যে কমিটমেন্ট, তার সঙ্গে যাচ্ছে না। যারা হামলা করেছে, তারা জুলাইয়ের শ্লোগানগুলোকে ব্যবহার করেছে। এভাবে তারা জনমত তৈরি করেছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যাকআপ রয়েছে। এই তিন শক্তি এক না হলে এত বড় ঘটনা ঘটনো সম্ভব ছিল না।’

মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আনার যুদ্ধটা একদিনের না, এই যুদ্ধ অনেকদিন চলবে। এটা চলতে থাকবে যতদিন না আমরা বিজয়ী হই। সে পর্যন্ত সবাই আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’

হামলা থামানোর চেষ্টায় সেই রাতে ডেইলি স্টার ভবনের সামনে গিয়ে হেনস্তার শিকার নিউ এইজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, ‘সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধতা এখন বেশি প্রয়োজন। আগামীতে আমরা আরো বড় ধরনের আয়োজন করব।’

নোয়াব সভাপতি ও সমকাল প্রকাশক এ কে আজাদ বলেন, ‘সবাই একটা কথা বলেছেন, আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে এটা প্রতিরোধ করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত না ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, ছায়ানট, উদীচীসহ সকল হামলার বিচার না হবে, ততোদিন আমাদের আন্দোলন চলবে।’

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ‘এই হামলার প্রতিবাদ জানাই। গণমাধ্যমের ওপর হামলা মানেই রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সঙ্গে হামলা করা।’

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘ডেইলি স্টার, প্রথম আলোসহ বাংলাদেশের সকল গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে স্বস্ব দায়িত্ব পালন করবে, সেটা আমাদের প্রত্যাশা। এটা আমরা বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট করেছি। আমরা মনে করি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রত্যেকের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। অতীতেও সিনিয়র সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের উপর হামলা হয়েছে। এই কাজের সঙ্গে কে বা কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা উচিত, আইনের আওতায় আনা উচিত। এই হামলার যেন ফুলস্টপ হয়।’

অন্যদের মধ্যে ছায়ানট সভাপতি সরোয়ার আলী, সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসি) সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান, প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী, অ্যাপেঙ ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, মেট্টোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান মাশরুর আরেফিন, এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন প্রতিবাদ সভায়। প্রতিবাদ সভার পর সোনারগাঁও হোটেলের বাইরে একটি মানববন্ধনে অংশ নেন সবাই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংবাদমাধ্যমে হামলায় সরকারের একটি অংশের সংশ্লিষ্টতা দেখছেন নাহিদ
পরবর্তী নিবন্ধ২০ জনকে দেওয়া হয়েছে গানম্যান, প্রথম আলো ডেইলি স্টার সম্পাদকও পেয়েছেন