প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার আমেরিকান কোভিড ১৯-এ মারা গেছে, যা করোনায় মৃত্যুর ৩০ শতাংশ এবং একক দেশ হিসেবে প্রথম। এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। আমেরিকার হাসপাতালের আইসিইউতে বেড পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। টিকা তৈরি হলেও পরিকল্পিত সরবরাহ ব্যবস্থাপনা না থাকায় টিকা কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। করোনাভাইরাস আমেরিকার স্বাস্থ্য বিভাগকে মারাত্মক বিপজ্জনক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। আর্থিক অবস্থাও একই পথে। বেকারত্বেও হার দিনদিন বাড়ছে যা কয়েক দশকের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বিনামূল্যে খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ। অভিবাসনের দেশে অভিবাসীরা কোনঠাসা। সবকিছুই যেন লণ্ডভণ্ড। স্বপ্নের দেশ যেন দুঃস্বপ্নে ভরা।
এরই মধ্যে কংগ্রেস ভবনে হামলা করে অভূতপূর্ব চমক দেখিয়েছে ট্রাম্পপন্থী সমর্থকরা। অধিবেশন চলাকালীন কংগ্রেস ভবনে প্রবেশ করে হামলা চালায় তারা। আইন প্রণেতারা জীবন বাঁচাতে ভয়ে নিরাপত্তার জন্য নিরাপদে লুকিয়ে ছিল। এই ভবনটি আমেরিকান সার্বভৌমত্বের শক্তি এবং শালীনতার একটি স্বীকৃত প্রতীক। এ হামলা প্রমাণ করে দেয় যে, স্পর্শকাতর এই জায়গায়টি আমেরিকায় কতটা অরক্ষিত, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামপ্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘাটতি। ফলশ্রুতিতে পুলিশসহ ছয়টি প্রাণ ঝরে পড়লো।
বিশ্ববাসীসহ আমেরিকানরা দেখলো কিভাবে হামলাকারীরা অতিসহজে নিরাপত্তা বাহিনীকে পরাভূত করে ভবন দখলে নেয়। ঊর্ধ্বকক্ষ, নিম্নকক্ষ, স্পিকার অফিসসহ সকল কক্ষে প্রবেশ করে তছনছ করে দেয় এবং দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা ব্যাঘাত ও অবরুদ্ধ থাকে। ১৮১৪ সালে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী ওয়াশিংটন ডিসির প্রতিরক্ষা ভেদ করে মশাল এবং গান পাউডার দিয়ে এই ভবন, প্রেসিডেন্টের বাসস্থান এবং অন্যান্য সরকারি দফতর পুড়িয়ে দেয়।”
এই হামলা রাশিয়ার সাইবার হামলাকারীচক্র, চীনা গোয়েন্দা বাহিনী কিংবা তথাকথিত জিহাদি গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের ফসল নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট তার সমর্থকদের উস্কে দিয়ে এই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন যা যুক্তরাষ্ট্রের ২০০ বছরের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নজিরবিহীন।
বিদায়ী ৪৫তম রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প যিনি এর আগে তাঁর সমর্থকদের রাজধানীতে যাত্রা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং ভোট জালিয়াতির কারণে নির্বাচনে হারার দাবি পুনরাবৃত্তি করছেন। নির্বাচনে পরাজিত হয়েও কারচুপি করে তাকে হারানোর অভিযোগ তুলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সব কিছুই করেছেন ট্রাম্প। আদালতে ৬০টি মামলা করে সবকটিতেই হেরেছেন। প্রদেশগুলোর নির্বাচনী কর্মকর্তরা অনেকে তাঁর দলের সদস্য, তারাঁও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলছেন। নজিরবিহীন নিশ্ছিদ্র নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার কথা এফবিআই ঘোষণা করেছে। তারই মন্ত্রণালয় হোমল্যান্ড এবং আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুষ্ঠু হয়েছে বলে ঘোষিত হয়েছে। তারপরও ওয়াশিংটন ডিসিতে হামলাকারীদের স্পষ্টভাবেই অনুরোধ করেছিলেন যেন তারা চুপ করে চলে না যায়, বরং দেশকে ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াই করার আহবান করেছেন। এতে প্রাণহানি, কংগ্রেস ভবন আক্রমণ ভাঙচুর, কক্ষ তছনছ করে দেওয়া হয়। বিশ্ব হতভাগ হয়ে দেখলো কিভাবে ট্রাম্পের স্বার্থপরতা এবং অসত্য কথা আমেরিকান মানুষের মুখে তাঁর ইচ্ছাটা এঁটে দিলেন, ৬৫ ভাগ তাঁর সমর্থকরা তা বিশ্বাসও করলো। ক্ষমতায় থাকার জন্য ক্যু করার চেষ্টা করলেন। আর আমেরিকা দুইভাগে পরিণত হলো ।
এসবের মূল কারণ ছিল, জো বাইডেনকে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ঘোষণায় বাধা দেওয়া এবং আইনপ্রণেতারা যেন ট্রাম্পকেই জয়যুক্ত করে। সশস্ত্র হামলার মুখেও নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থেকে আইনপ্রণেতারা জো বাইডেনের বিজয়কে অনুমোদন করেছে। এটিই ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের সর্বশেষ ট্রাম্প কার্ড। তাঁর ধারণা ছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট যেহেতু উচ্চকক্ষের সভাপতি এবং তিনিই প্রতিনিধি পরিষদের ফলাফল ঘোষণা করবেন ট্রাম্পের ইচ্ছানুযায়ী। কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্ট বিবেক আর সংবিধানের কাছে হার মেনে শেষ পর্যন্ত বাচিঁয়ে দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও নির্বাচনব্যবস্থা। আর পরাজিত হয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা, উগ্র বর্ণবাদী ও অগণতান্ত্রিক মানসিকতার। কংগ্রেস উচ্চ বিলাসিতা থামিয়ে দিয়ে পদলিত করে ট্রাম্পের উচ্চ আকাঙ্ক্ষার ।
তবে বিশৃঙ্খলার ধোঁয়াশা এখনও হয়তো শেষ হয়নি। ৫০টি প্রদেশেই তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে, সব প্রদেশের রাজধানীতে সেনা মোতায়ন করা হয় । ওয়াশিংটনে ২৫ হাজার সেনা মোতায়ন করে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় । নির্বাচিত জন প্রতিনিধিরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এফবিআই সারা দেশে রেড এলার্ড জারি করে।সামাজিক মাধ্যমগুলো বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে ব্লক করে রেখেছে।
এটি একটি সংকট, তবে এটি কেবলমাত্র ২০২০ সালের নির্বাচনের কারণে তৈরি হয়নি, বা কেবল ট্রাম্পের সময়েও হয়নি। শাসনের এই সংকট কয়েক দশক ধরেই চলছে। যা ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারিতে বিষ্ফোরিত হয়েছে। মার্কিন গণতন্ত্র ৯ / ১১ এর পর থেকে মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে।
শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র এখনও মারাত্মক বিপদে হয়তো পড়েনি, বিশেষত এর বিচার বিভাগের কারণে। যদি এ হামলা অন্য কোন দেশে ঘটতো, তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তো এবং সরকারের সহজ পতন হতো। তবে আপাতত আমেরিকা হয়তো নিরাপদে, তবে তা আর কত দিন? অনেকে মনে করেন আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মধ্যে ফাটল না ধরলেও দাগ পড়েছে। সবকিছু মিলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমেরিকানরা অশান্তিতে এবং জাতিগত বৈষম্য ও বিভাজনের কারণে উত্তেজনা সর্বকালের শীর্ষে, আমেরিকান গণতন্ত্র আজ প্রশ্নবিদ্ধ ও হুমকিতে পরিণত হয়েছে। ইউরোপসহ আমেরিকার সাথীরা হতভম্ব!
সামপ্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করা হয়। কারণ এসব মিডিয়ার কারণে আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রে এখন জাতিগত বর্ণ বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। নাগরিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে অবাধ নির্বাচন ব্যর্থ। মহামারিকালীন অব্যবস্থাপনা ও বিশ্ব নেতৃত্বে ব্যর্থতার কারণে আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হচ্ছে।
গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচনকে বুঝায় না বরং অনেক বিষয়ের সমষ্টি যা সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য কাজ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভাবিত করে। যেমন নাগরিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানো। যাতে জনগণ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস রাখে। বিশ্বাস ক্ষয় হওয়ার সাথে সাথে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বৈরাচারী মনোভাব তৈরি হয়। আমেরিকান গণতন্ত্র হয়তোবা এখনই শেষ হচ্ছে না, তবে এটি যেভাবে হওয়া উচিত তার কার্যকারিতা দুর্বল হচ্ছে, যা সুশীল সমাজ এবং বিশ্ব নেতারদরকে ভাবিয়ে তুলছে। আইনের শাসনে চলমান আক্রমণ, সত্য-ভিত্তিক সাংবাদিকতা এবং গণতন্ত্রের অন্যান্য নীতি ও নিয়ম আরও হ্রাসের সম্ভাবনা থাকে। ৬ জানুয়ারি ঘটনাগুলো অবশ্যই আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত হবে!
ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে সফল সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে পরিচিত। এই দেশের রাষ্ট্রপতি পৃথিবীর অনেক দেশের জন্য একটি গণতন্ত্রের প্রতীক। ৬ জানুয়ারি কোন গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ ছিল না, এটি ছিল জনগণের ভোটের প্রতিফলনের বিরুদ্ধে শাসকদলের ‘অভ্যুত্থান’ ।
হামলাকারীদের মধ্যে সাবেক -বর্তমান সামরিক কর্মকর্তা, পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তাব্যক্তিরাও ছিল। এতে বুঝা যায় এটি একটি পরিকল্পিত হামলা। ট্রাম্প নিজেই নির্বাচনের আগে থেকেই বিভিন্নভাবে বলে আসছিলেন। ক্যাপিটাল হিল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় সহিংসতা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতার মেয়াদ। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, অস্ত্র ও পেশি শক্তি দিয়ে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা রোধ করা যায় না।
আমেরিকান সংবিধানের ভাষায় যদি বলতে হয়, ন্যায়বিচার সবার জন্য এবং কেউই এর ঊর্ধ্বে নয়। তাইতো আমেরিকার ইতিহাসে তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিনিধি পরিষদে দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ পর্যন্ত ২৭৬ জন হামলাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। অনেক আইন প্রণেতা এই বিদ্রোহকে প্ররোচিত করেছিল তাদেরও খুঁজা হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর কারণেই ক্ষমতায় থেকেও সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতাবানহীন। নীতি নৈতিকতা অধঃপতন হয়নি এখনো।
৬ জানুয়ারির ছায়া আমেরিকা জুড়ে দীর্ঘ সময় ধরে থাকবে। এর ক্ষয়কারী প্রভাব ৪৬তম মার্কিন রাষ্ট্রপতি থাকার পরেও বহাল থাকবে আগামীতে! আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমেরিকা ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে বেশ কিছু সময় লেগে যাবে। কিন্তু যেভাবে জাতিগত এবং বর্ণ বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে তা কি ঠেকানো যাবে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কী নতুন করে সংজ্ঞায়িত হবে!
লেখক : উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি
ও টেকসই উন্নয়নকর্মী