অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক খাতে সংস্কার ও নানা উদ্যোগের মধ্যেও খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে তিন মাসে এই অঙ্ক বেড়েছে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা, যা আগের তিন মাসের তুলনায় আড়াই গুণেরও বেশি; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র বলেছেন, ‘নীতি পরিবর্তনেই’ এই উল্লম্ফনের কারণ। খবর বিডিনিউজের।
নতুন অর্থবছরের তিন মাসের মধ্যে অগাস্টের ৪ তারিখ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ৮ অগাস্ট থেকে ক্ষমতায় অন্তর্বর্তী সরকার, এই পট পরিবর্তনের মাঝে তিনদিন দেশ ছিল সরকারবিহীন। গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা সাংবাদিকদের জানান, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। এটি বিতরণ করা ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। তিন মাসে টাকার অঙ্কে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এই তিন মাসের কোন মাসে কত বেড়েছে, সেই হিসাব অবশ্য প্রকাশ করা হয়নি।
জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। তারও তিন মাস আগে মার্চ শেষে ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। ওই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত তিন মাসে মার্চ–জুন প্রান্তিকের তুলনায় খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার ২৫৪ শতাংশ। বরাবরের মতই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণর অঙ্ক ছিল এক লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, যা ছিল বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। মার্চ শেষে বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা যা ছিল বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ সবশেষ বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিদেশি ও বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির খুব একটা নড়চড় হয়নি এই তিন মাসে। সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা যা বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। জুন শেষে এই অঙ্ক ছিল ২ হাজার ২২৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা যা বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ। জুন শেষে এই ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা যা বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
তিন মাসে এত বাড়ল কেন : মার্চ থেকে জুন প্রান্তিকের তুলনায় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে খেলাপির অঙ্ক এত বাড়ল কেন–এই প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র ও পরিচালক শাহরিয়ার সিদ্দিক দুটি কারণের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, বড় রকমের নীতি পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ঋণের হিসাব গণনায় বিশেষ এক ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়। অনেকগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ কিস্তি পরিশোধের শেষ তারিখ থেকে ছয় মাস পর্যন্ত গণনা করা হত না। আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার সাপেক্ষে সেটি কমিয়ে তিন মাস করা হয়েছে। আগামী বছরের মার্চে এটি কিস্তি পরিশোধের সময় শেষ হওয়ার পরের দিন থেকেই করা হবে। এই পরিবর্তনের কারণেই সেই বকেয়া কিস্তিগুলো খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। যদি আগের নীতি বলবৎ থাকত, তাহলে খেলাপি ঋণ এত বাড়ত না। খেলাপি ঋণ নিয়ে আদালতে চলতে থাকা অনেক রিট খারিজ হয়েছে জানিয়ে একে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন শাহরিয়ার সিদ্দিক।