কক্সবাজারের চকরিয়ায় টানা বর্ষণ ও পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে সৃষ্ট স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে উপজেলাজুড়ে। এই বন্যায় কম করে হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু অতীতের অনেক বন্যায়ও এমন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি চকরিয়াবাসীকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাতামুহুরী নদী থেকে সৃষ্ট অসংখ্য ছড়া খাল রয়েছে উপজেলাজুড়ে। সেসব ছড়া খাল ছিল একেবারেই খরস্রোতা। মানুষের জীবন–জীবিকার জন্য এসব ছড়া খাল একসময় বাণিজ্যিক কাজেও ব্যবহৃত হতো। আর বর্ষকালে এসব ছড়া দিয়ে দ্রুতই সাগর–মোহনায় নেমে যেত পানি। কিন্তু বিগত ২০ বছর ধরে প্রতিবর্ষায় ভুগতে হচ্ছে উপজেলাবাসীকে। তবে বেশি সমস্যা দেখা দেয় ২০২০ সালের পর থেকে। ওই বছরও ভয়াবহ বন্যার শিকার হয়েছিলেন এখানকার মানুষ। তবে সেই বন্যার চেয়ে এবারের বন্যার ভয়াবহতা ছিল অনেক বেশি; যা মানুষকে অবাক করে দিয়েছে।
সরজমিন দেখা গেছে, পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীর একটি শাখা খালের নাম ‘পোড়া মাতামুহুরী’। এই শাখা খালটি বিভিন্ন উপ–খাল হয়ে সরাসরি গিয়ে মিশেছে চকরিয়া উপকূলের সাগর মোহনায়। খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ কোথাও ১০০ ফুট আবার কোথাও আরো বেশি। এই শাখা খালটিও ছিল খরস্রোতা। এই খালই ছিল মানুষের যাতায়াতের একসময়ের একমাত্র মাধ্যম। মাতামুহুরী নদীর এই শাখা খালটির অবস্থান চকরিয়া উপজেলার বিএমচর ও পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নে।
সরজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, একসময়ের খরস্রোতা এই শাখা খালটির পুরোটাই গিলে ফেলেছে দখলবাজরা। তারা পাঁচ কিলোমিটার এই খালটিকে ভরাট করে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছে। কোথাও ১০ ফুট আবার কোথাও ৫ ফুটও অবশিষ্ট নেই খালটির। শুধু কি তাই, পানি চলাচলের জন্য কয়েক ফুট উন্মুক্ত রেখে কোথাও কোথাও পুরো খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবনও। আবার কোথাও কয়েকফুটের নাঁশি দিয়ে খালের ওপর তৈরি করা হয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সড়ক থেকে শুরু করে অন্তত দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা। অপরদিকে পূর্ব বড় ভেওলার আরেক শাখা ‘বেতুয়া খালের’ মাঝখানেই উঠে গেছে বহুতল ভবন।
পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের সাবেক ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (তহশিলদার) মো. আবুল মনসুর দৈনিক আজাদীকে জানান, আরএস ও বিএস রেকর্ড অনুযায়ী মাতামুহুরী নদীর শাখা এই বেতুয়ার খাল। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ কোনো কোনো এলাকায় সর্বনিম্ন ৩০ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ৬০ ফুট পর্যন্ত। এই খালটি বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলা ও পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত।
স্থানীয়রা জানান, খালটির বিভিন্ন স্থানে দুই দিকের তীর দখল করা হয়েছে। বানিয়ারচর অংশে খালের মাঝখানে মাটি ফেলে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন। এতে চলতি বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা বানের পানি ভাটির দিকে আর নামতে পারেনি। এই অবস্থায় ভয়াবহ বন্যা–তাণ্ডবের শিকার হয়েছে তিন ইউনিয়নের চরপাড়া, দিয়ারচর, ফজু মিয়াজির চর, বানিয়ারচর, পশ্চিম সিকদারপাড়া, বেতুয়ার কূলসহ অন্তত ২০টি গ্রামের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি।
‘পোড়া মাতামুহুরী’ খাল দখল হওয়া নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এলাকার অসংখ্য সচেতন শিক্ষার্থী দৈনিক আজাদীকে জানান, মাতামুহুরী নদীর এই শাখা খাল বহমান হয়েছে বিএমচর এবং পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের বুক চিরে। এই দুই ইউনিয়নের গ্রামীণ এলাকার যাবতীয় পানি চলাচলের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে এই খাল। কিন্তু গত ২০ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে এই খালটি দখল করতে করতে একেবারে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। এমনকি পানি চলাচল করতে কয়েকফুট খোলা রেখে খালের ওপর আস্ত বহুতল ভবনও নির্মাণ করায় কারো পক্ষে সহজে বুঝার উপায় থাকবে না, এখানে যে প্রবহমান একটি খাল রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তাই করা হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, পানি চলাচলের একমাত্র প্রবহমান পোড়া মাতামুহুরী শাখা খালটি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে ফেলায় অতি বর্ষণের পানি আর ভাটির দিকে নামতে পারেনি। এতে কয়েকদিন ধরে পানিতে আটকা পড়ে বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলাসহ আশপাশের আরো একাধিক ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসী আরও জানান, ২০২০ সালের বন্যায় একনাগাড়ে কয়েকদিন পানিবন্দি অবস্থায় ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন মানুষগুলো। তারা উপায়ান্তর না দেখে দখল করে ফেলা খালটি উন্মুক্ত করার দাবিতে মাঠে নামেন। পোড়া মাতামুহুরী খালটিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে এলাকায় এলাকায় গণস্বাক্ষর অভিযানও চালান তারা। এমনকি খালটি উন্মুক্ত করতে স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলম, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত আবেদনও জানান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এরইমধ্যে ফের ভয়াবহ বন্যার শিকার হতে হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষকে।
‘পোড়া মাতামুহুরীর করুণ দৃশ্য দেখা যায় উপজেলার বিএমচর ইউনিয়নের বেতুয়া বাজার এলাকায়। এই বাজার এবং সড়কের দক্ষিণাংশে অবস্থিত পুরো খালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বহুতল ভবনও। এসব ভবনে রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও সংস্থার শাখা অফিস। রয়েছে কমিউনিটি সেন্টার থেকে শুরু করে ছোট–বড় অসংখ্য স্থায়ী স্থাপনা।
ভূমি অফিসের নথিতে দেখা গেছে, ভেওলা মানিকচর মৌজার বিএস ৬ নম্বর সিটের ও বিএস ৫৭৫৯ দাগের অর্ন্তভুক্ত এই খালটি পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নিয়ন্ত্রণাধীন। বিগত সময়ে মৎস্য চাষ, অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের শর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কেউ কেউ একসনা লিজ নেয়। এর পর সেই লিজ গ্রহীতারা তাদের মৌরসী সম্পত্তির মতো সেই খালের ওপর গড়ে তুলেছেন স্থায়ী ইমারতও। এক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ম্যানেজ হয়ে নিরব থাকেন বলে ভুক্তভোগী এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।
কালাগাজী সিকদারপাড়ার বাসিন্দা আজিজুল হক, মোস্তফা কামাল, সাজ্জাদ হোছাইন, শাহদাত হোছাইনসহ অসংখ্য ভুক্তভোগী জানান, মাতামুহুরী নদীর শাখা, উপ–শাখা খালগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘পোঁড়া মাতামুহুরী’। এই খালটি বেতুয়া বাজার থেকে দক্ষিণ–পশ্চিম দিক হয়ে বুড়া মাতামুহুরী নদীর সাথে মিশে গিয়ে সরাসরি উপকূলে সাগর মোহনায় মিলিত হয়েছে। পূর্ব বড় ভেওলা ও বিএমচর ইউনিয়নকে পৃথক করেছে এই পোড়া মাতামুহুরী খাল। প্রমত্তা এই খালে এককালে ছিল জোয়ার–ভাটা। এই খালে চলাচল করত ইঞ্জিন চালিত নৌকা, সাম্পান থেকে বিভিন্ন নৌ–যান। এই খালই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু বর্তমানে পোড়া মাতামুহুরী নামের খালের সেই জৌলুস এখন আর নেই। নেই আগের পানি চলাচলের সেই স্রোতধারা। পোড়া মাতামুহুরীর বুকে এখন দেখা মিলবে শত শত অবৈধ স্থায়ী স্থাপনা।
প্রবহমান এই খালের ওপর বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন জয়নাল আবেদীন নামের এক শিক্ষক ও তার ভাই নেজাম উদ্দিন। তন্মধ্যে খাল দখলকারী জয়নাল আবেদীন দাবি করেছেন, এটি কোনোকালেই খাল ছিল না। তবে ছড়ার মতো ছিল। তাও ১০ থেকে ১২ ফুটের মধ্যে হবে। তাঁর বাবা সেখানে দোকান করতেন। ২০১৩ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে লিজ নেন ওই জায়গাটি। তবে পানি চলাচলের সুবিধাও রেখেছেন। এজন্য ভবনের নিচে বেশ কয়েকফুট উন্মুক্ত রাখেন। যাতে পানি চলাচল করতে পারে। লিজের মেয়াদ আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।
বিএস সিট এবং দাগ অনুযায়ী প্রবহমান এই খালের দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১০০ ফুটের বেশি জানিয়ে বিএমচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম জাহাঙ্গীর আলম ও পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ারুল আরিফ দুলাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, বিগত ২০ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে পোড়া মাতামুহুরী খালটি জবর–দখল করে ফেলা হয়। এর পর সুযোগ বুঝে সেখানে বহুতল ভবন পর্যন্ত তৈরি করা হয়। এতে খালটি সংকুচিত হতে হতে বর্তমানে কয়েকফুটে গিয়ে ঠেকেছে। এই অবস্থায় খালটির পুনরুদ্ধার করার জন্য প্রশাসনিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
আরও যেসব খাল দখল–বেদখল হয়েছে : অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চকরিয়াজুড়ে অন্তত ২০টি খাল দখল–বেদখলের তথ্য মিলেছে। তন্মধ্যে রয়েছে পৌরসভার সবুজবাগের ওপর দিয়ে একসময়ের প্রবহমান বাটাখালী ছড়া, উপকূলীয় এলাকার মাছকাটা খাল, টাক্কুয়ার ফাঁড়ি খাল, ইছারফাঁড়ি খাল, চারালিয়া খাল, বাটামণি খাল, কেরুনখালী খাল, চৈরভাঙ্গা খাল, ডুলখালী খাল, কুদুকখালী খাল, চিলখালী খাল, পানখালী খাল, লেন্ডিচিরা খাল অন্যতম।
চকরিয়ার বিভিন্ন ছড়া খাল দখল–বেদখল নিয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাহাত উজ–জামান দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমার দপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীণ যেসব খাল দখল বা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছিল তা দফায় দফায় সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীণ যেসব খাল রয়েছে সেখানে অনেককে লিজও দেওয়া হয়। লিজের সেই সুযোগকে অবৈধভাবে কাজে লাগিয়েছে গ্রহীতারা।
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, প্রবহমান খাল দখলকারী এবং অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের তালিকা তৈরি করা হবে। পোড়া মাতামুহুরী ও বেতুয়া খালকে অবশ্যই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেওয়া হবে।
তবে খালগুলো উন্মুক্ত করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ডক্টর তানজির সাইফ আহমদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমার দপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘পোড়া মাতামুহুরী’ খালটি উন্মুক্ত করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কোথাও যদি খালের ওপর স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা হয় তাও সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। কাউকে লিজ বা বন্দোবস্ত দেওয়া তা খতিয়ে দেখে, সেই লিজও বাতিল করা হবে।
এই বিষয়ে কক্সবাজার–১ আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, প্রবহমান যেসব ছড়াখাল দখল, দূষণসহ অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে তা অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর–প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।