খাল-নালা রক্ষণাবেক্ষণে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চাইবে চসিক-সিডিএ

এ বছর পাউবোকে রেগুলেটর হস্তান্তর ।। দুর্ঘটনা রোধে নিরাপত্তা বেষ্টনীর ওপর জোর ।। অন্যান্য প্রকল্পগুলোর পারিপার্শ্বিকতার কারণে এবারও জলাবদ্ধতা হতে পারে

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৭ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের কাজ শেষে খাল-নালাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে জনবল এবং এ খাতে ব্যয় নির্বাহে অর্থ সংস্থান নিশ্চিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভা আহ্বানের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও সিডিএ নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করবেন।
গতকাল বুধবার জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্প নিয়ে অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। টাইগারপাসস্থ নগর ভবনের অস্থায়ী কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। মেগা প্রকল্পের আওতায় পাঁচটি খালে পাম্পসহ রেগুলেটর লাগানোর কাজ শেষ হবে আগামী জুনে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের কাছে সেগুলো চালানোর মতো প্রশিক্ষত জনবল নেই। তাই চলতি বছর রেগুলেটরগুলো পরিচালনার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়িত্ব দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে সভায়। গত বর্ষায় খাল-নালায় পড়ে প্রাণহানি ঘটেছে। এবার এমন ঘটনা এড়াতে চসিক ও সিডিএ নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের খাল-নালায় যেন ফেন্সি (নিরাপত্তা বেড়া বা বেষ্টনী) দেয় তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় সভায়। সভা থেকে এ বছর নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষায় কোনো আশার বাণী ছিল না। তবে আগের চেয়ে নগরবাসীকে কম ভুগতে হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। এছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান সিডিএর আরেকটি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ না হলেও পুরোপুরি সুফল মিলবে না বলে জানানো হয়।
সভায় চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বক্তব্য দেন। প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী। প্রকল্প এলাকভু্‌ক্ত কাউন্সিলরগণও বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
নিরাপত্তা বেষ্টনীতে জোর মেয়রের : দুর্ঘটনা রোধে খাল ও নালার পাড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণে জোর দিয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বর্ষা সমাগত। বর্ষার আগে মানুষের মধ্যে আতংক সৃষ্টি হয়। বিগত সময়ে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। খাল ও নালায় পড়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে ফেন্সি দেয়ার কাজ চলমান আছে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের অধীনেও কিছু কিছু জায়গায় করেছে। সেটাও চলমান আছে। উভয় সংস্থা যার যার অধীনে যেখানে কাজ চলছে সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বর্ষা মৌসুমের আগে ফেন্সি দিতে হবে। স্ল্যাব ভেঙে গেলে ঠিক করে দিতে হবে। যাতে অতীতের মতো দুর্ঘটনা না ঘটে।
মেয়র বলেন, বর্ষায় পনি উঠবে। কিন্তু দ্রুত যেন নিষ্কাশিত হয় সে জন্য পথ তৈরি করে দিতে হবে। বর্তমানে অনেক জায়গায় পানি জমে আছে। সেগুলো স্যুয়ারেজের। বাঁধ থাকায় সেখানে পানি আটকে আছে। অবশ্য প্রকল্প পরিচালক নিজেই বলছেন বাঁধ থাকলে অপসারণ করে দেয়া হবে। তাই সমন্বয় সভা থেকে মোটামুটি আশার আলো দেখছি। গতবারের চেয়ে এবার কম হবে। আগামীবার আরো কম হবে।
আন্ত:মন্ত্রণালয় সভা প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, মে মাসে উনি যেগুলো শেষ হয়েছে ক্লিয়ার করে দিবেন। এরপর ভরাট হয়ে যাক, শুকিয়ে যাক উনারা আর হাত দেবেন না। তখন এটা সিটি কর্পোরেশনের ঘাড়ে পড়বে। এর আগে অবিলম্বে আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠক করে রক্ষণাবেক্ষণের অর্থের সংস্থান করতে হবে। মে মসের পর যদি প্রকল্প পরিচালক বলেন, বুঝিয়ে দিয়েছি আমাদের আর দায়িত্ব নেই। তখন আমরা কি করবো। টাকা নেই, জনবল নেই। তাই মেইনটেইন করতে না পারলে আগের অবস্থানে চলে যাবে। জনগণের ভোগান্তি হবে।
মেয়র বলেন, এটা আপনারাও (সিডিএ) মন্ত্রণালয়কে জানান, সিটি কর্পোরেশনের টাকা ও জনবল নেই। মেইনটেনেন্সের জন্য প্রতি বছর ১০০ কোটি টাকা মত থোক বরাদ্দ লাগবে। আপনারা জানান। আমরাও জানাচ্ছি। এটা কালক্ষেপণ করা যাবে না।
মেয়র বলেন, স্লুইচ গেটের জন্য টেকনিক্যাল লোক আমাদের হাতে নেই, লোকবল কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়িত্ব দিতে পারি। যেহেতু প্রশিক্ষণ দিতে সময় লাগবে। ওনাদের লোক আছে।
তিনি বলেন, শহরকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখার জন্য সিডিএ কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের অধীনে যে সব খাল-নালা আছে সেগুলোতেও আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। আবর্জনা ও মাটি উত্তোলন করছি। তিনি বলেন, গত বছর নগরবাসীর বেশ ভোগান্তি হয়েছিল। প্রকল্পের কাজ চলছে ভোগান্তি হবে স্বাভাবিক। আমাদের সবার উদ্দেশ্য লক্ষ্য এক। সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশনের চাওয়া নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়া। আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।
স্লুইচ গেটের দায়িত্ব পাউবো নিতে না চাইলে কী হবে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের মেয়র বলেন, এটা আহামরী কী। উনারা না নিলেও ব্যবস্থা হয়ে যাবে। স্লুইচ গেট নির্মাণ করতে পারলে রক্ষণাবেক্ষণ করা যাবে না? খাল-নালায় ময়লা ফেলা বন্ধ করতে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও ঘোষণা দেন মেয়র।

প্রকল্পের সুফল পেতে অপেক্ষা : জলাবদ্ধতা পুরোপুরি মুক্তি পেতে সময় লাগতে পারে জানিয়েছেন সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ। তিনি বলেন, কাজ করার ফলে আগের চেয়ে জলাবদ্ধতা হয়তো আগের চেয়ে কমে আসবে। তবে পুরোপুরি সুফল পেতে একটু সময় লাগবে। কারণ এটা চার বছরের প্রকল্প। মাত্র তো দুই হয়েছে। আরো দুই বছর বাকি আছে। তিনি বলেন, এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ আছে। আবার সিটি কর্পোরেশনের কিছুৃ কাজ আছে। সবগুলো সম্পন্ন হলে জলাবদ্ধতার সমাধান হবে। তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদী যদি ড্রেজিং করা না হয় তাহলে শহরের খাল-নালা পরিষ্কার রাখলেও সুফল আসবে না। কর্ণফুলী যদি ভরাট হয়ে যায়, ওখানে চর পড়ে যায় তাহলে পানি যাবে না। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর সবসময় সেবা সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় করে কাজ করার চেষ্টা করেছি। সিটি কর্পোরেশন, বন্দর, কর্ণফুলী গ্যাস, পিডিবি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সবার সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছি।
খাল ও ড্রেন বুঝে নেয়ার আহ্বান : মেগা প্রকল্পের আওতায় যেসব খাল ও ড্রেনের কাজ শেষ হয়েছে তা বুঝে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী। তিনি বলেন, ৫৪ কিলোমিটার ড্রেনের কাজ শেষ করেছি। সাতটা খালের কাজ শেষ করেছি। জুনের মধ্যে আরো ১১ টির শেষ হবে। এসময় কাজ শেষ হওয়া খাল বুঝে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমাদের প্রকল্প ভৌত কাজের জন্য। মেইনটেনেন্সের জন্য না। তারপরও আমাদের ইক্যুইপমেন্ট থাকে বলে সেটা দিয়ে পরিষ্কার করে দিই।
তিনি বলেন, আমরা হস্তান্তর করে দিলেও সেগুলো যেন আবার ভরাট হয়ে না যায় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। লোকজন ময়লা ফেলছে। বাজারের এমন কোনো জিনিস নাই ফেলে না। এতে আগাছা জমে যায়। মানুষ এসব ময়লার উপর দিয়ে হাঁটতে পারে।
সহজে মুক্তি মিলছে না : নগরে চলমান অন্য প্রল্পের কাজ শেষ না হলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি না মেলার ইঙ্গিত দিয়েছেন লে. কর্নেল শাহ আলী। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতার জন্য আরো তিনটি প্রকল্প আছে। কিন্তু সবাই মনে করে জলাবদ্ধতার কাজ শুধু আমরা করছি। সিডিএ আরেকটি প্রকল্পে রেগুলেটর নির্মাণ করছে। গত বছর খাল পরিষ্কার থাকলেও খালের মুখে রেগুলেটরের নির্মাণ কাজের জন্য প্রশস্ততা কম ছিল। ফলে ১ মিনিটের পানি পাঁচ মিনিটে যেতে পেরেছে নদীতে। এবারও যদি এমন হয় তাহলে বলতে পারবো না জলাবদ্ধতা হবে না। তিনি বলেন, অন্যান্য প্রকল্পগুলোর পারিপার্শ্বিকতার কারণে জলাবদ্ধতা হতে পারে। কারণ ওসব প্রকল্পগুলোও জলাবদ্ধতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। আমরা আমাদের কাজ শেষ করলাম। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের জন্য রেগুলেটর দেয়ার সময়ও কিন্তু খালে বাঁধ দেয়া হবে।
তিনি বলেন, আমরা অনেক কাজ করেছি। প্রবর্তক মোড়ে কিন্তু এখন জলাবদ্ধতা হয় না। তিনি বলেন, শহরের পানি খালে নেয়ার জন্য প্রথমে ড্রেনের কাজ শেষ করেছি। তিনি বলেন, এক ঘন্টা-দুই ঘন্টা পানি থাকলে সেটাকে জলাবদ্ধতা বলা যায় না। উন্নত দেশেও এমন হয়। তিনি বলেন, বছরে বছরেও প্রকল্পের কাজ হয় না বলে আলোচনা হয়। বাস্তবতা হচ্ছে পাঁচ-ছয় মাসের বেশি কাজ করতে পারি না। জলাবদ্ধতা প্রকট হয় না এমন খালগুলোতে এ বছর মে-জুন মাসেও কাজ করা হবে বলে জানান তিনি।
কাউন্সিলরদের অভিযোগ : প্রকল্পের কাজ চলছে এমন এলাকার কাউন্সিলরগণ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন স্থানীয় কাউন্সিলরগণ। কাউন্সিলর মোর্শেদ আলী বলেন, বন্দর এলাকায় মহেশখালে যে রিটেইনিং ওয়ালের কাজ হচ্ছে সেখানে মাটি খালে ভরাট হয়ে গেছে।
মো. ইসমাইল বলেন, মহেশখালী খালের ফইল্যাতলী খালে মাটি ভরাট হয়ে গেছে। পানি চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। গ্রিন ভিউ এলাকায় রিটেইনিং ওয়ালের কোনো কাজ হচ্ছে না। কেন জানতে চাচ্ছি। মোবারক আলী বলেন, চান মিয়া সাওদাগর রোড দুই বছর যাবত ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে আছে মির্জা খালের পশ্চিম পাশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কারণে। মো. নুরুল আমিন বলেন, গয়নাছড়া খাল ভরাট হয়ে আছে। সরাইপাড়ায় কোনো কাজ ধরেন নি।
হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, টেকপাড়া ও ফিরিঙ্গিবাজার খালে কাজ ধীরগতিতে হচ্ছে। বংশাল রোডে অধিগ্রহণের পরও কাজ শুরু হয়নি। তিনি বলেন, সেবক কলোনির একটা ভবন হেলে পড়েছে। বালিবাহী একটা ট্রাক বাসায় ঢুকে গেছে। আলকরণর কয়েকটা গলিতে পানি জমে আছে। মান্নান গলিতে সবসময় পানি উঠে। ময়লা নেয়ার সময় ফেলে চলে রাস্তা নষ্ট করে ফেলছে। মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছে।
আশরাফুল আলম বলেন, চাক্তাই খালে বাঁধ আছে। বাঁধের কারণে গতবার মেয়র মহোদয়ের বাসয় পানি উঠেছে। পরিষ্কার না করলে এবারও উঠবে। কাজী নুরুল আমিন বলেন, নোয়াখাল ও ডোমখাল বৃষ্টির আগে পরিষ্কার করে দেয়ার অনুরোধ করেন। উত্তর মোহরার জন্য কৃষ্ণ খাল। গতবার সেনাবাহিনী পরিষ্কার করে। এবার শুনলাম এটা নাকি মেগা প্রকল্পে নাই। বক্তব্য রাখেন জিয়াউল হক সুমন, আবদুস সালাম, পুলক খাস্তগীর। উপস্থিত ছিলন-প্যানেল মেয়র মো. গিয়াস উদ্দিন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমদ মঞ্জু, আবদুল মান্নান, সালেহ আহমদ চৌধুরী ও সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না : প্রধানমন্ত্রী