দেশে সরকারি খাদ্যশস্যের মজুদ দ্রুতই কমছে। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান চাল সংগ্রহ অভিযানও সফল হয়নি। খাদ্য মজুদ বাড়াতে এখন আমদানিতেই ভরসা রাখতে হচ্ছে। সরকারি গুদামে মজুদ কমে আসায় খাদ্যশস্যের বাজারেও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে আবার গুদামে কীটপতঙ্গ আক্রমণের শঙ্কা বাড়ছে বলে খবর মিলছে। সম্প্রতি বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বিভিন্ন বৈঠকেও কীটপতঙ্গের আক্রমণের বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। একথা সত্য, দেশের সরকারি খাদ্য গুদামের অধিকাংশ স্থাপনাই বেশ পুরনো। এসব খাদ্যগুদামে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিবেশেরও অভাব রয়েছে। ফলে এসব খাদ্য গুদামে কীটের আক্রমণের শঙ্কা থেকে যায়। আবার সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় বিভিন্ন সময়ে গুদামজাত খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের দিক থেকে বিষয়টি দুশ্চিন্তার বৈকি।
মজুদ খাদ্যের মান রক্ষায় মানসম্পন্ন গুদাম নির্মাণের বিকল্প নেই। এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, সরকার এরই মধ্যে আধুনিক সাইলো ও গুদাম নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বটে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য এবং কাজের গতি অপেক্ষাকৃত শ্লথ। স্বল্পমেয়াদে বিদ্যমান খাদ্য সংরক্ষণের গুদামের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ উন্নত করার বিকল্প নেই। জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ গুদামে আর্দ্রতা বজায় রেখে খাদ্য মজুদ করা কঠিন বলে খবর মিলছে। জরাজীর্ণ গুদামগুলোর মেঝে, ছাদ, এমনকি দেয়ালগুলো খাদ্য মজুদের উপযুক্ত নয়। এ কারণে প্রায়ই সরকারি খাদ্য বিতরণের সময় নিম্নমান বা পোকাসহ খাদ্যশস্য প্রদানের অভিযোগ মেলে। গুদামের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত খাদ্য রাখতে গিয়েও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় না, যা খাদ্যের আর্দ্রতা বিনষ্ট করে। আর্দ্রতা না থাকায় কীটপতঙ্গের আক্রমণের শঙ্কাও বেড়ে যায়। এখান থেকে খাদ্যশস্য রক্ষায় খাদ্য গুদামের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ উন্নত করতে হবে। খাদ্যশস্য মজুদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ রক্ষায় এর ব্যবস্থাপনাও উন্নতি করতে হবে। আবার স্থাপনা নির্মাণ বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে, যাতে সাইলোয় কীটপতঙ্গ জন্মানোর সুযোগ কমে। এছাড়া বাতাসের আর্দ্রতা ও উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত কারিগরি সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। সংরক্ষণাগার ব্যবহারে নির্দিষ্ট বিধি রয়েছে, সেটিও মানা জরুরি। সক্ষমতার অতিরিক্ত মজুদ না রাখা, মানসম্পন্ন ব্যাগের ব্যবহার নিশ্চিত করাও এর আওতায় পড়ে।
সরকারি খাদ্যগুদামে কীটপতঙ্গের আক্রমণ এবং অন্য কারণে খাদ্যশস্যের ক্ষতি এড়াতে একই সঙ্গে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। পাকা মেঝে স্থাপন এবং যথাযথ উচ্চতা বজায় রাখার মাধ্যমে বিদ্যমান খাদ্য গুদামগুলোকে আর্দ্রতা প্রতিরোধী করতে হবে, যাতে কীটের আক্রমণের সুযোগ সৃষ্টি না হয়। খাদ্যশস্য সংরক্ষণে বৈশ্বিকভাবে অনুসরিত যথাযথ বিজ্ঞানসম্মত উত্তম চর্চাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। সব খাদ্যগুদামে পোকা দমনে কীটনাশক স্প্রে করার পাশাপাশি ফামিগেশনের মতো ব্যবস্থাগুলো জোরদার করতে হবে। বস্তাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তৈরি নিম্নঘনত্বের পানিরোধী পলিথিন দিয়ে ঢেকে সেগুলো শক্তভাবে বেঁধে রাখতে হবে। যোগ্য ও প্রশিক্ষিত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে গুদামগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। মজুদকৃত খাদ্যশস্যের স্বাস্থ্য ঠিক আছে কিনা তা নিয়মিত বিরতিতে তদারক করতে বিভিন্ন পর্যায়ে একটি নিবিড় যাচাই ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। কারিগরি সহযোগিদের মাধ্যমে গুদামগুলো ১৫ দিন বা এক মাস পরপর শতভাগ পরীক্ষা করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য বিনষ্ট হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত কমিটির সুপারিশেও বিষয়গুলো রয়েছে। দেশটি খাদ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে এ সুপারিশের ওপর নির্ভর করে পদক্ষেপ নিচ্ছে।
খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। খাদ্য মজুদ ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সিঙ্গাপুর এখন মডেল। তাদের মডেলটি কেমন, তা যাচাই-বাছাই ও পর্যবেক্ষণপূর্বক আমাদের এখানে প্রয়োগ করা যেতে পারে। দেশগুলো খাদ্য মজুদের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুুক্তির সহায়তা নেয়। কম্পিউটারাইজ ব্যবস্থায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হয় বলে কোন গুদামের খাদ্যের মান কেমন তা প্রতিদিনই তারা একটি স্থানে বসেই দেখতে পারে। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়। কোন গুদামের পণ্য আগে বাজারে ছাড়তে হবে বা কোন মজুদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হচ্ছে প্রভৃতি তথ্য সামনে থাকলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। বাংলাদেশও এটি অনুসরণ করতে পারে।