দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এবং আশপাশের এলাকায় বিগত কয়েক বছর যাবত সৃষ্ট জলাবদ্ধতার মূলে রয়েছে খাল ভরাট ও অবৈধ স্থাপনা। সম্প্রতি জলাবদ্ধতার কারণ, অর্থনৈতিক প্রভাব ও এর প্রতিকার নিয়ে এক গবেষণা রিপোর্টে বিশেষজ্ঞরা এ অভিমত দিয়েছেন। গত সোমবার নগরীর আগ্রাবাদ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, সব সেবা সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করলে খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। এতে চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, শত শত বছর ধরে নৌ-পথে বাণিজ্য পরিচালনায় খাতুনগঞ্জ-কোরবানীগঞ্জ-চাক্তাই এলাকার গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। ৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে ক্রমান্বয়ে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি ও অতি বৃষ্টির ফলে এই এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। তার সাথে খাল, নালা-নর্দমা ভরাটের ফলে বিভিন্ন গুদাম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জলমগ্ন হয়ে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় উদ্ভাবনে পরিকল্পনা কমিশনের এনআরপি প্রকল্প ও ইউএনডিপির উদ্যোগে পরিচালিত এই সমীক্ষার চূড়ান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প গ্রহণ করে একনেকে পাস করার মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, কয়েক বছর আগেও পলিথিন নিষিদ্ধ করায় এর ব্যবহার হতো না। এই পলিথিনের ব্যবহার আবার বেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম শহরের এই পলিথিন গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলীতে। যার কারণে কর্ণফুলীর ড্রেজিং কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম চেম্বারের নেতৃবৃন্দ পলিথিন ব্যবসা নিয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে এর ব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে আলোচনা করতে পরে। খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের দুর্দশার জন্য আমরাই দায়ী। আমরা খালে ময়লা ফেলে, খাল ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করেছি। যার কারণে খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের এই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এখনো সময় আছে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার। তিনি আরো বলেন, খালে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে আমাদের আরো কঠোর হতে হবে। তাহলে ওই এলাকার জলাবদ্ধতা কমানো সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চট্টগ্রামের ড্রেইনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাকে উন্নত করে অল্প সময়ে পানি নিষ্কাশন ত্বরান্বিত করার জন্য ১৯৬৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পাঁচটি মাস্টার প্ল্যান/সম্ভাব্যতা স্টাডি সম্পন্ন করা হয়েছে। এর মধ্যে চউক-এর ১৯৯৪ সালের ড্রেইনেজ ও স্যুয়ারেজ মাস্টার প্ল্যান অন্যতম। গত বছরের জুলাই মাসে সমাপ্ত হয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড সুয়ারেজ অথরিটির ‘ড্রেইনেজ মাস্টার প্ল্যান – ২০১৭’। প্রকৌশলগত কিছু ঘাটতি থাকলেও এই মাস্টার প্ল্যান মোটামুটি মান সম্পন্ন বলেই মনে হয়েছে। এখন মাঠ পর্যায়ে মাস্টার প্ল্যানের রূপায়ন করতে হবে যাতে জলাবদ্ধতার নিরসন হয়। তাঁরা আরো বলেন, পাঁচ দশক আগেও চট্টগ্রাম শহরের বুক চিরে বয়ে যেতো অসংখ্য খাল। বৃষ্টি এবং জোয়ারের পানি নিঃসরণের এগুলোই ছিল প্রধান পথ। কিন্তু খালের আশেপাশে বসবাসকারীরা খাল দখল করেই থেমে থাকেনি, খালগুলোকে পরিণত করেছে আবর্জনার ভাগাড়ে। ক্রমশ ভরাট হয়ে চাক্তাই খালসহ অনেক খাল এখন ছোটো নালায় রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে অল্পবৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। নালা, নর্দমা, খাল সহ যত্রতত্র যাতে মানুষ আবর্জনা না ফেলে সেজন্য সবাইকে সচেতন করতে হবে। খাল দখল করে বাড়ি কিংবা ব্যবসায়িক স্থাপনা নির্মাণ করে বাড়ির আয়তন হয়তো কিছুটা বাড়ানো যাবে কিন্তু বর্ষার মওসুমে সেই খালের পানিই যে নিজের বাড়িই জলমগ্ন করতে পারে এই বিষয়টি সবার মনে রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাবদ্ধতা সমস্যার মূলে রয়েছে জনগণের নাগরিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব। চসিক, চউক, কিংবা বিদেশি কনসাল্ট্যান্ট, কারো কাছেই আলাদিনের চেরাগ নেই যে চাইলেই পরদিন জলাবদ্ধতা দূর করে দেবেন। তাই প্রযুক্তিগত সমাধানের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে একজন সুনাগরিকের দায়িত্ব পালন করার জন্য জনগণকে সচেতন এবং উদ্বুুদ্ধ করতে হবে। মহল্লার সর্দার, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও সামাজিক সংগঠনগুলো এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পারে। খাতুনগঞ্জে জলাবদ্ধতার মূলে যে সমস্যা রয়েছে, তা নিরসনের লক্ষ্যে খালের আশেপাশে তৈরি অবৈধ স্থাপনাগুলো অচিরেই উচ্ছেদ করা জরুরি।