খাগড়াছড়িতে ৭০ সেতু, বদলে গেছে সড়ক যোগাযোগ

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি | সোমবার , ৫ জুলাই, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব এবং উত্তর -পূর্ব সীমান্তের জনপদ পার্বত্য চট্টগ্রাম। আয়তনে ৫ হাজার ৯১ বর্গমাইল। ১৮৬০ সালে রাঙামাটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। ১৯৮৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা থেকে খাগড়াছড়ি আলাদা জেলা হিসেবে মর্যাদা পায়। ভূ-প্রাকৃতিক গঠনের কারণে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভিন্নরূপ রয়েছে। উঁচু নিচু পাহাড়ের পথ ধরে তৈরি হয় সড়ক যোগাযোগ। তবে পাহাড়ি সড়ক যোগাযোগের অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল বেইলি সেতু বা ব্রিজ। আপদকালীন সময়ের জন্য তৈরি হওয়া এসব ব্রিজ দিয়ে কেটে গেছে প্রায় ৪ দশক। এসব ব্রিজ ছিল যোগাযোগের ‘মরণফাঁদ’। ব্রিজ ভেঙে গেলে সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হত। ব্রিজ মেরামতে সময় লাগত ১০ থেকে ১৫ দিন। সড়কের যানবাহনের চাপ বাড়ার সাথে সাথে বেইলি ব্রিজে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে বর্তমানে সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন নিরাপদ। বেইলি ব্রিজের পরিবর্তে পিসি গার্ডার বা পাকা সেতু তৈরি হওয়ায় বেইলি ব্রিজের ‘ভোগান্তি’ দূর হয়েছে। তৈরি হয়েছে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা। দুইটি আলাদা প্রকল্পে খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে ৭০ টি পাকা সেতু। চলতি বছরের জুন মাসে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হওয়া প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৫৬ টি পিসি গার্ডার সেতু। এতে ব্যয় হয়েছে ২১৮ কোটি টাকা। এর আগে জাপানি সংস্থা জাইকার সহায়তায় ১৪ টি সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করে সড়ক ও জনপদ বিভাগ।
খাগড়াছড়ি থেকে মাটিরাঙার তানাক্কাপাড়ার দূরত্ব প্রায় ৪৬ কিমি। এই সড়কের ৩ বেইলি ব্রিজ ও ৩ টি কালভার্ট ছিল। প্রায়শ দুর্ঘটনা হত। বেইলি ব্রিজের পাটাতন প্রায়শ ভেঙে পড়ত। তবে বর্তমানে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। পাকা সেতু নির্মিত হওয়ায় নিরাপদ হয়েছে সড়ক যোগাযোগ। সড়কে এখন নিয়মিত যাতায়াত করছে ট্রাক, বাসসহ মালবাহী ও যাত্রীবাহী পরিবহন। একই অবস্থা খাগড়াছড়ির পানছড়ি ধুদুকছড়া পর্যন্ত ১৬টি বেইলি ব্রিজ ও ২ টি কালভাট ছিল। সেখানেও এখন পাকা সেতু। ফলে সহজেই যাতায়াত করতে পারছে।
খাগড়াছড়ি লক্ষীছড়ি সড়ক, খাগড়াছড়ি -দীঘিনালা বাঘাইছড়ি সড়ক, জালিয়াপাড়া, রামগড়, মহালছড়ি সড়কে নির্মিত হয়েছে ৫৬ টি পাকা সেতু। এতে কমেছে ভোগান্তি।
খাগড়াছড়ি পানছড়ি সড়কে ধরে ১৯ বছর মালবাহী গাড়ি চালান ফরিদ মিয়া। তিনি জানান, ‘একসময় এই সড়কে চাঁন্দের গাড়ি নিয়ে উপজেলা থেকে জেলায় পণ্য পরিবহন করতাম। বিভিন্ন সময় বেইলি ব্রিজ ভেঙে গেলে যোগাযোগ বন্ধ হত। বছরে ৭ থেকে ৮ বার ব্রিজ ভেঙে পড়ত। বিকল্প উপায় না থাকায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেত। তবে এখন পাকা সেতু হওয়ায় আমাদের ভোগান্তি দূর হয়েছে। বেইলি সেতুতে ৫ টনের বেশি মালামাল বহন করা যেত না। এখন ২৫ টনের ট্রাকও চলাচল করে। ’
যাত্রীবাহী গাড়ির চালক কামাল (৩৪) হোসেন জানান, ‘ এই রাস্তায় গাড়ি চালান ১২ বছর। চট্টগ্রাম ও ঢাকা সড়কে ২০ টি বেশি বেইলি ব্রিজ ছিল। ভারী যানবাহন চলাচল করলে এসব ব্রিজ ভেঙে যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকত। রাঙামাটি হয়ে যাতায়াত করতে হত। এতে সময় বেশি লাগত। তবে এখন সেই অবস্থা নেই। পাহাড়ি রাস্তা থেকে বেইলি ব্রিজ উঠে যাওয়ায় আমরা নিরাপদে চলাচল করতে পারছি। পাকা সেতু হওয়ায় ভারী যানবাহন ও যাত্রীবাহী গাড়ি চলাচল করতে পারে।’
খাগড়াছড়ি শান্তি পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান খলিল বলেন,‘ পাহাড়ি সড়ক আঁকাবাঁকা হলেও যান চলাচলে তেমন বিঘ্ন ঘটত না; বেইলি ব্রিজের কারণে যত বিপত্তি ঘটত। ব্রিজগুলোতে একাধিক গাড়ি চলাচল করতে পারত না। ৫ টনের বেশি ধারণ ক্ষমতার যানবাহন বেশি চলাচল করলে ব্রিজ ভেঙে পড়ত। পাকা সেতু নির্মাণ করা এখানকার মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল। ইতোমধ্যে ৭০ টি পাকা সেতু নির্মিত হওয়ায় আমাদের যাতায়াতের ভোগান্তি দূর হয়েছে। দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণ হয়েছে।’
খাগড়াছড়ি চেম্বার অব কর্মাসের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. কাশেম বলেন, ‘বর্তমানে খাগড়াছড়িতে পর্যটন অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা খাগড়াছড়ি আসছেন। এই অবস্থায় নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া খাগড়াছড়ি থেকে কৃষিজ ও বনজ পণ্যবাহী যানবাহন বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করে। পাহাড়ে নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ছিল অন্যতম চ্যালেঞ্জ। পাকা সেতু নির্মিত হওয়ায় পুরো জেলার সড়ক নেটওর্য়াক মজবুত হয়েছে। তবে এখনো খাগড়াছড়ি দীঘিনালা, লংগদু ও সাজেক সড়কে ১০টি বেইলি সেতু রয়েছে। বেইলির পরিবর্তে পাকা সেতু নির্মাণ হলেও জেলায় বেইলি সেতুর অস্তিত্ব থাকবে। পাহাড়ে যানচলাচল নিরাপদ হবে। ’
খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সবুজ চাকমা জানান, ‘২০১৫ সালে শুরু হওয়া পিসি গার্ডার বা পাকা সেতু নির্মাণের কাজ চলতি বছরের জুনে শেষ হবে। সড়ক ও জনপদ বিভাগ ২১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৬ টি ব্রিজের নির্মাণ কাজ শেষ করেছে। এর মধ্যে ৫০ টির কাজ শতভাগ শেষ হয়েছ। বাকি ৬ টি ব্রিজের কাজ শেষ পর্যায়ে। এছাড়া খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগ ১০টি বেইলি ব্রিজের পরিবর্তে পাকা সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এটি প্রক্রিয়াধীন।’
খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিল মোহাম্মদ ফয়সাল জানান, ‘পাহাড়ি নদী ও ছড়ার উপর পাকা সেতু নির্মাণ করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ভরা বর্ষায় ছড়া ও নদীতে হরকাবান হয়। নানা প্রতিবন্ধকতার পরও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৬ টি ব্রিজের কাজ শেষ হয়েছে। এতে পাহাড়ি চলাচল নিরাপদ হয়েছে। এছাড়া ৭০ কোটি ব্যয়ে আরো ১০ টি পাকা সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন কিউএমজি সাইফুল আলম, ডিজিএফআইয়ের দায়িত্বে তাবরেজ শামস
পরবর্তী নিবন্ধগ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করতে ব্যাংকারের অপহরণ নাটক