এতদিন ফুসফুসের ক্যান্সারেই আক্রান্তের হার বেশি ছিল পুরুষের। তবে সামপ্রতিক সময়ে এ চিত্র পাল্টে গেছে। কয়েক বছর ধরে ফুসফুসের স্থলে পুরুষের মুখ গহ্বর ও গলার (হেড অ্যান্ড নেক) ক্যান্সারই শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের তথ্য–উপাত্ত পর্যালোচনায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, জিহ্বা, কন্ঠনালী, নাক, দাঁতের মাড়িসহ প্রায় ১৪ ধরনের ক্যান্সার মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারের আওতাভুক্ত। সবমিলিয়ে পুরুষের শরীরের এ অংশ জুড়ে (গহ্বর ও গলার) এখন বেশি মাত্রায় ক্যান্সার ধরা পড়ছে। ধূমপান ছাড়াও পানে জর্দাসহ তামাকজাত বিভিন্ন পণ্য গ্রহণের কারণেই এ ধরনের ক্যান্সার দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী।
ক্যান্সার ওয়ার্ড সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে (২০২১ সালে) শুধু আউটডোরেই প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার (১৭ হাজার ৪৭৬ জন) রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়েছে ক্যান্সার ওয়ার্ডে। সেবা গ্রহণ করা এসব রোগীর মধ্যে নতুন রোগীর সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি (৬ হাজার ২৯৩)। বাকি ১১ হাজার ১৮৩ জন নিয়মিত রোগী। যারা আগে থেকেই আউটডোরের (বহিঃ বিভাগের) সেবা গ্রহণ করে আসছিলেন। নতুন শনাক্ত ৬ হাজার ২৯৩ জনের মাঝে পুরুষ রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৬০ জন। আর নারী রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ২৩৩ জন। হিসেবে নারী রোগীর তুলনায় ক্যান্সার বিভাগে সেবা গ্রহণ করা পুরুষ রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। ওয়ার্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে আউটডোরে চিকিৎসা নেয়া ৪ হাজার ৬০ জন পুরুষ রোগীর মধ্যে মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৭১ জন। যা মোট পুরুষ রোগীর ১৯ শতাংশ। পুরুষদের ক্যান্সারের মধ্যে এর পরের অবস্থানে রয়েছে ফুসফুস ক্যান্সার। ১৭ শতাংশ পুরুষ রোগী এ ক্যান্সারে আক্রান্ত। আক্রান্তের সংখ্যা ৬৯০ জন। এছাড়া পুরুষদের ১১ শতাংশ (৪৪৬ জন) খাদ্যনালী ক্যান্সারে, ৫ শতাংশ (২০৩ জন) মলদ্বার ক্যান্সারে এবং ৪ শতাংশ (১৬২ জন) পাকস্থলী ক্যান্সারে আক্রান্ত। বাকি রোগীরা অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
একই সময়ে (গত এক বছরে) ওয়ার্ডের ইনডোরে (আন্তঃবিভাগে) ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ হাজার ৯৬৪ রোগী। এর মাঝে পুরুষ রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৭০০। ইনডোরে চিকিৎসা নেয়া পুরুষ রোগীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারে। ৩২৩ জন রোগী এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন। যা মোট পুরুষ রোগীর ১৯ শতাংশ। এরপরই বেশি (২৮৯ জন) রোগী ফুসফুস ক্যান্সারের।
যা মোট পুরুষ রোগীর ১৭ শতাংশ। চিকিৎসা নেয়া বাকি রোগীরা পর্যায়ক্রমে খাদ্যনালী, মলদ্বার ও পাকস্থলীসহ অন্যান্য ক্যান্সার আক্রান্ত।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গতবছর (২০২১ সালে) ওয়ার্ডের আউটডোর ও ইনডোরে চিকিৎসা সেবা নেয়া পুরুষ রোগীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারে। এরপরই অবস্থান ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্তদের। ২০২০ সালেও একই চিত্র দেখা গেছে। ২০২০ সালে আউটডোরে চিকিৎসা নেয়া মোট নতুন রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৬২৬ জন। এর মাঝে পুরুষ রোগী ছিল ২ হাজার ৯৬০ জন। চিকিৎসা নেয়া পুরুষ রোগীদের মাঝে মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৬২ জন (১৯ শতাংশ)। আর ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী ছিল ৫০৩ জন। যা মোট পুরুষ রোগীর ১৭ শতাংশ।
তবে ২০১৯ সাল ও এর আগের বছরগুলোতে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। ২০১৯ সালে আউটডোরে চিকিৎসা নেয়া মোট নতুন রোগীর সংখ্যা ৫ হাজার ৭৮৮ জন। এর মাঝে পুরুষ রোগী চিকিৎসা নেন ৩ হাজার ৫৭ জন। বাকি ২ হাজার ৭১১ জন নারী। চিকিৎসা নেয়া পুরুষ রোগীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি রোগী ছিল ফুসফুস ক্যান্সারের। ৬৪১ জন রোগী ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন। যা মোট পুরুষ রোগীর ২১ শতাংশ। এরপর ছিল মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী। ১৩ শতাংশ রোগী (৩৯৭ জন) এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন। ইনডোরে চিকিৎসা নেয়া পুরুষ রোগীদের মাঝেও বেশি আক্রান্ত ছিল ফুসফুস ক্যান্সারে। ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী ছিল ২৬২ জন। যা মোট পুরুষ রোগীর ২১ শতাংশ। আর মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী ছিল ১৬২ জন (১৩ শতাংশ)।
ওয়ার্ডের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৮ সালে ওয়ার্ডে চিকিৎসা সেবা নেয়া মোট পুরুষ রোগীদের মাঝে ৩৩ শতাংশ ছিল ফুসফুস ক্যান্সারের। আর মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী ছিল ২৫ শতাংশ। ২০১৭ সালে মোট পুরুষ রোগীদের মাঝে ৪০ শতাংশ ছিল ফুসফুস ক্যান্সারের। আর মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী ছিল ২০ শতাংশ। ২০১৬ সালে পুরুষ রোগীদের মাঝে ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী ছিল ৪২ শতাংশ। আর ১৯ শতাংশ রোগী আক্রান্ত ছিল মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত (টানা চার বছর) পুরুষ রোগীদের মাঝে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও হার ছিল বেশি। তবে ২০২০ থেকে এ চিত্র পাল্টে যায়। ২০২০ সালে ফুসফুস ক্যান্সারের স্থলে প্রথম অবস্থানে উঠে আসে পুরুষের মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সার। ২০২১ সালেও এই ধারাবাহিকতা বজায় আছে।
ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসকরা বলছেন, মুখ গহ্বর ও গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা হিসেবে রেডিওথেরাপি দিতে হয়। আর ২০১৮ সালের আগে ওয়ার্ডের রেডিওথেরাপি মেশিন অকেজো ছিল। যার কারণে রেডিওথেরাপি সেবা বন্ধ ছিল। নতুন মেশিন আসার পর ২০১৮ সালের শেষ দিকে পুনরায় রেডিওথেরাপি সেবা চালু হয়। নতুন মেশিনের সেবা চালুর পর থেকে মুখ গহ্বর ও গলার (হেড অ্যান্ড নেক) ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা সেবা পাচ্ছেন। যার কারণে ওয়ার্ডে এ ধরনের (মুখ গহ্বর ও গলার) ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে বলে জানান ক্যান্সার বিভাগের প্রধান ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ। ক্যান্সার মুক্ত জীবন পেতে হলে জর্দ্দা, সিগারেট ও তামাকজত দ্রব্য পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছেন ক্যান্সারের এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
ক্যান্সার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলছেন, মানুষের জীবন–যাপনের অভ্যাস বা লাইফস্টাইলের কারণে ক্যান্সারের ঝুঁকি দিনদিন বাড়ছে। ইনডোর তো আছেই, আউটডোরেও রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এই ব্যাধি থেকে বাঁচতে হলে এখনই সচেতন হতে হবে। অবশ্য, আগের তুলনায় মানুষের মাঝে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। যার কারণে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। আগে অনেকেই ঝাড়–ফুঁক কিংবা বৈদ্য–তাবিজ করে সময় ক্ষেপণ করতেন। আর ডাক্তারের কাছে আসতেন শেষ পর্যায়ে। এখন পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। আগে দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী আউটডোরে চিকিৎসা সেবা নিলেও এখন প্রতিদিন একশ’রও বেশি রোগী সেবা নেন। তবে ক্যান্সার নিয়ে মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।