প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থক বিদ্রোহীরা গত জানুয়ারি আমেরিকার ক্যাপিটল হিল (কংগ্রেস মিলন স্থল) দখল নেয়। কংগ্রেস তখন নির্বাচনী কলেজ ভোট গণনার সাপেক্ষে বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের বিজয়কে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্যে বসেছিল। ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সও উপস্থিত ছিলেন। বিদ্রোহীদের আয়োজন দেখে অনেকে ভাবছেন এটা পূর্ব পরিকল্পিত। তাছাড়া, ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে ক্রমাগত বলে গেছেন নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। তার উস্কানিমূলক বক্তব্য এই আক্রমণের নিয়ামক – অনেকের বিশ্লেষণ। বিভিন্ন ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে আমেরিকার গণতন্ত্রের তীর্থস্থান দখলে নিল। তারপর রিচার্ড বারনেট আরাকানসাস স্টেটের এক বাসিন্দা – বুট তুলে বসেন স্পিকার পেলসির চেয়ারে। বারনেটের সেই ছবি হামলার ধৃষ্ট প্রতীক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইন্টারনেটে। বিদ্রোহীদের সাদা বর্ণের দেখা যায়। তারা ইহুদী গোষ্ঠীর মানুষের প্রতি ঘৃণার বার্তাও বয়ে বেড়ান। অনেকে বলেন, এই কাজ যদি অন্য বর্ণের কেউ করত তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে সবাই মারা পড়ত। তাই এই হামলাকে আমেরিকায় প্রোথিত বর্ণবাদের নগ্ন দলিল বলা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাকী দিনগুলোতে ট্রাম্প মিথ্যার বেসাতি করে আরো সংঘাত উস্কে দিতে পারেন আশংকায় সামাজিক মাধ্যমগুলো বিভিন্ন মেয়াদে ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। বিদ্রোহ উস্কে দেয়ার জন্যে ট্রাম্প অভিশংসিতও হয়েছেন। সামগ্রিকভাবে, এই প্রেক্ষাপটে দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে।
উদার গণতন্ত্র থেকে সভ্যতার সংকট নাকি প্রোথিত বর্ণবাদ?
আমেরিকা পক্ষের শক্তির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ের পর পশ্চিমা আদলে উদার গণতান্ত্রিক শাসনের ধারণা পৃথিবীব্যাপী নায্যতা লাভ করে। এরপর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙার পর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফুকুইয়ামা তো ঘোষণা দিলেন আমেরিকার ‘উদার গণতন্ত্র’ শাসনতন্ত্রের শেষ সীলমোহর। নৈতিকভাবে উৎকর্ষ সাধনের আর কিছু নেই। তবে ফুকুইয়ামার শিক্ষক প্রফেসর হান্টিংটন বললেন, কোল্ড ওয়ার শেষ হল, কিন্তু নতুন যুদ্ধের শুরু। তা হবে আট ধরনের সভ্যতা পরিচয়ের মধ্যে (পশ্চিমা, লাতিন আমেরিকা, ইসলামিক, চৈনিক, হিন্দু, অর্থোডঙ, জাপানিজ এবং আফ্রিকান)। আমেরিকার গত দুই নির্বাচনে হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘর্ষ নতুন রূপ পায়। ট্রাম্প ও উগ্রবাদী ডানপন্থী গোষ্ঠী চীন, ইসলাম ও অভিবাসী ভীতি প্রচারের মাধ্যমে নিজেদের বেশি দেশপ্রেমিক প্রমাণের চেষ্টা করে। সভ্যতার সংঘর্ষ একেবারে আমেরিকার অভ্যন্তরে, মানুষে মানুষে লেগে যায়। তাছাড়া, ট্রাম্প ও সাদা উগ্রবাদী গোষ্ঠী আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষজনের ন্যায়বিচার প্রত্যাশার আন্দোলন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ এর বিরোধিতা করে। ফলে, ক্যাপিটল হিলে সাদা উগ্রবাদীদের হামলায় প্রশ্ন ওঠে এ বিদ্রোহ শুধু সভ্যতার বিভাজন নয়, বরং আমেরিকায় প্রোথিত বর্ণবাদেরও সামষ্টিক প্রকাশ। কথা সত্য, তবে কিছু বিষয় বিশদভাবে ভাবতে হবে। প্রথমত, চীনের বিনিয়োগ যেভাবে পশ্চিমে আলোচিত হয়, স্পষ্ট যে চৈনিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পশ্চিমে সভ্যতার ভয় হিসেবে কাজ করবে। বাইডেন জয়ী হলেও পপুলার ভোটের ৪৬% এর মতো কিন্তু ট্রাম্পের পক্ষে গেছে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম দেশগুলার সাথে পশ্চিমের সংঘর্ষের কথাটা স্রেফ সরলীকরণ। ওবামা প্রশাসনের সাথে সৌদি সম্পর্ক শীতল থাকলে, ট্রাম্প প্রশাসনের তা ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ। এ সম্পর্ক ইরানের বিরুদ্ধে জোট হিসেবে ইসরাইল-আমেরিকার মিলিত সম্পর্কের সমপ্রসারণ বলা যায়। সব মুসলিম- সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাদ দেন, শুধু ইরান, তুরস্ক ও সৌদি আরবকেও এক রাজনৈতিক ব্লকে ফেলা যায় না। তৃতীয়ত, বর্ণবাদ কে নির্বাচনে এক নিয়ামক হিসাবে ধরলেও তাকে শুধুমাত্র কারণ হিসাবে বলা যাবে না। আমেরিকায় বিদ্যমান এবং ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসমতার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের তথাকথিত ‘আমেরিকান ড্রিম (পরিশ্রম করলেই সফল হওয়া যায় বা আরো উন্নত অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণীতে উত্তরণ হয়) ভেঙে পড়েছে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মাধ্যেমে সম্পদ কতিপয় পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভুত হবার সম্ভাবনা আরো বেশি। এরকম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে জনগণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিরোধী যে কোন মিথ্যা আশ্বাসে প্ররোচিত হবে সহজে, বর্ণ, জাতের ভিত্তিতে অলীক শত্রু পেলে তো আর কথা নেই।
গণতান্ত্রিক বৈশিষ্টের পুনঃমূল্যায়ন
অনেকে ভাবছেন, উদার গণতন্ত্র ক্যাপিটল আক্রমণে হেরে গেল। এই ভাবনা স্বল্প বিবেচনাপ্রসূত। প্রথমত, আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানই কিন্তু ট্রাম্পের স্বেচ্ছাচারী আচরণ থেকে জনগণকে বাঁচিয়েছে। ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপ্রধান হবার পরেও তিনি নির্বাচন কমিশন ও কোর্ট কাচারিতে নির্বাচন বিষয়ক সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, কিছুটা হলেও গণতন্ত্রের অপপ্রয়োগের কারণেই অসম সমাজ গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন কোম্পানিগুলোকে কর-মাফ, প্রণোদনার মাধ্যমে ক্ষমতাবান হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে সম্পদের অধিকার খর্ব করেছে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সাধারণ মানুষের কর-ব্যবস্থাপনায় নেই দামী আইনজীবী। আর, বড়লোকদের কর-এড়ানোর নানা ফন্দি ফিকিরের জন্য প্রস্তুত আইনজীবী ও হিসাবরক্ষকেরা। এটা গণতন্ত্রের অপপ্রয়োগ ছাড়া আর আর কী?
প্রযুক্তির পরিবর্তন, নতুন সামাজিক মাধ্যম ও বাক স্বাধীনতা
ট্রাম্পের সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলা বন্ধ করে দেয়া কি তার ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ দেওয়ার অধিকারের খর্ব হয়নি? এই ধারণা ‘মিথ্যা বক্তব্য’ ও ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ পার্থক্য করার জটিলতায়। গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা অবাধ নয়। আমেরিকার প্রথম ‘ডিক্লারেশান অব ইন্ডিপেন্ডেস’ নিশ্চিত করেছে ব্যক্তির ‘জীবন, স্বাধীনতা, ও সম্পদের’ অধিকারকে ‘অবিচ্ছেদ্য অধিকার’ হিসেবে। ট্রাম্প রাজনৈতিক বক্তব্যের আদলে মিথ্যার বেসাতি করে মানুষের জীবন ও সম্পদকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন। তবে, বিভিন্ন দেশ সামাজিক মাধ্যমের বক্তব্য সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেও আমেরিকা ট্রাম্পের বক্তব্যের নিয়ন্ত্রণ সামাজিক মাধ্যম কোম্পানিগুলোর উপর ছেড়ে দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ‘নতুন সামাজিক মাধ্যমে যেকোন মিথ্যা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়তে পারে’ – এর সরকারি না কি ব্যক্তি মালিকানাধীন নিয়ন্ত্রণ ভালো? উত্তর প্রেক্ষাপটসাপেক্ষ। তবে, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নিয়মিত সক্রিয় জবাবদিহিতার দায় থাকতে হবে।
পরিশেষে, ক্যাপিটল হিলের আক্রমণ দেখিয়ে দিয়েছে গণতন্ত্রের শক্তি কোথায়, দুর্বলতা কোথায়। গণতন্ত্র তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা মানুষের ন্যায়পরায়ণতা ও নিষ্ঠার উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি স্বাধীনতাও তাই। তবে সামাজিক মাধ্যমের প্রযুক্তিগত পরিবর্তনে আপাতত অমীমাংসিত প্রশ্ন হলো – সত্য আর রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে কী পার্থক্য। সেই প্রশ্নের ধুসর উত্তর না পেলে পৃথিবীজুড়ে জনমানুষের ‘বাক’ ক্ষমতাসীনদের খড়গ এড়াতে পারবে না।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, সমাজ বিজ্ঞান,
কর্নেল ইউনিভার্সিটি, নিয় ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র