কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া, মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নের মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রবাহিত নদীর নাম কোহেলিয়া। যুগ যুগ ধরে জোয়ার–ভাটায় আপন গতিতে ভরা যৌবনে প্রবাহিত হতো এই খরস্রোতা কোহেলিয়া। এই নদীর পাড়ে স্থাপিত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প। দখল দূষণ ও ভরাটের ফলে সমপ্রতি কঙবাজারের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এ নদী। দিন দিন ভরাট হচ্ছে কোহেলিয়া নদী। নদীর বুকে জাগছে ছোট ছোট অসংখ্য চর। ফলে জোয়ারের সময়ও বিঘ্নিত হচ্ছে নৌ চলাচল।
জানা যায়, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মযজ্ঞের সুবাদে এই নদী হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছেন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিভিন্ন বিভাগের ঠিকাদাররা। এতে একসময় নদীতে চলাচল করা কয়েক হাজার মণের লবণের কার্গো বোট চলাচল করলেও এখন সাধারণ নৌযান চলাচলই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন কোহেলিয়া নদীর পাশে ইউনূছখালী বাজারে মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। মানববন্ধনে তারা বিপন্ন এই কোহেলিয়া নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে খনন করে পুনরুদ্ধারের দাবি জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), কোহেলিয়া নদী রক্ষা কমিটি, কোহেলিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি ও উপকূল সুরক্ষা ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত মানববন্ধনে পরিবেশবাদী বক্তারা বলেন, মনুষ্যসৃষ্ট দখল দূষণ ও ভরাটের কারণে কোহেলিয়া নদী মারা গেলে এখানকার শত শত জেলে এবং লবণচাষী ও ব্যবসায়ীর জীবন হুমকির মুখে পড়বে। পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, কোহেলিয়া নদীর আশেপাশে চলমান অপরিকল্পিত ভরাট ও দখল প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করাসহ নদীর সীমানা নির্ধারণ করে তা পুনরুদ্ধার করা উচিত। কোহেলিয়া নদী রক্ষা কমিটি মহেশখালী আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, কোহেলিয়া যেভাবে দ্রুত ভরাট হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বিহিত ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই হারিয়ে যাবে এ নদী। তাই নদীটি খননের ব্যবস্থা করে জেলেদের মাছ ধরার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহেশখালীতে দেশের বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য মাতারবাড়ির দক্ষিণে ১ হাজার ৪১৪ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে সেখানে নির্মিত হয়েছে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প। প্রকল্পের মাটি ভরাট করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ করাকালীন কোহেলিয়া নদীর উল্লেখযোগ্য অংশ পলি মাটিতে ভরাট হয়ে যায়। বর্তমানে প্রকল্পের বিভিন্ন বর্জ্য ও মাটি পাইপের মাধ্যমে সরাসরি কোহেলিয়াতে ফেলে দিন দিন আরো ভরাট হচ্ছে নদীটি।
অপরদিকে প্রকল্প এলাকায় যাতায়াতের জন্য নদী ভরাট করে মাতারবাড়ি সেতু থেকে দক্ষিণে প্রায় ৩০০ ফুট প্রস্থ বিশাল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর কিছু অংশের উপর নির্মিত এই সড়কের কারণে দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে কোহেলিয়া। ফলে নদীতে চলাচলকারী ইঞ্জিনচালিত লবণের বোট ও বিভিন্ন ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে।
স্থানীয় জেলে নুরুল আলম জানান, এ নদীকে কেন্দ্র করে কয়েক হাজার পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু নদী দিন দিন ভরাট ও দখলের কারণে জেলেদের জালে আর আগের মতো মাছ ধরা পড়ছে না। ফলে বেকারত্ব ও অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাপন করছে হাজারো জেলে পরিবার।
লবণচাষী জাকের হোছাইন জানান, কোহেলিয়া ভরাটের কারণে পূর্ণ জোয়ারেও এখন বড় ও মাঝারি লবণ পরিবহনের কার্গো বোটসহ বিভিন্ন ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল করতে পারছে না। আগে এ নদীতে দেখা যেত পাঁচ হাজার মণ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন লবণের বোট চলাচল করতে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন পেশার মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল এ নদীর মাছ, কাঁকড়া ও লবণ।
কোহেলিয়া হারিয়ে যাওয়া মানে মহেশখালীর প্রায় লক্ষাধিক মানুষের জীবন–জীবিকা ধ্বংস হয়ে যাওয়া। পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা অবিলম্বে কোহেলিয়া নদী ড্রেজিং করে তা পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন।