ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সম্পাদিত ‘কোহিনূর’ পত্রিকার একটি দুর্লভ কপি দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের কাছে হস্তান্তর করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র, রাজনীতিবিদ মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। ৩য় বর্ষ ৭ম–৮ম সংখ্যা, ৪ঠা মার্চ ১৯৫৩, ২০ ফাল্গুন ১৩৫৯। এ সংখ্যায় যাঁদের লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তাঁরা হলেন ডা. লোকমান খান শেরওয়ানী, ছৈয়দ আবদুচ্ছালাম ইছাপুরী, এ এ রেজাউল করিম, অশোক চন্দ্র বড়ুয়া, মনিরুদ্দিন আহমদ, নুরুল আমিন, সেরাজুল ইসলাম, এম এ আলী, মোতাসীম বিল্লাহ, লাল খাঁ, রেভারেন্ড রেমন্দ দ্যা ইয়াগার প্রমুখ।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে গবেষকদের মতে, ১৯৪৭–এর দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপটে পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় ১৯৫০ সালে চট্টগ্রাম থেকে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সম্পাদিত সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকার প্রকাশ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক মুসলমান স্বাতন্ত্র্যবাদী ভাবাদর্শ আরোপ এবং বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানা ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে এই পত্রিকার উদার ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন এবং রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
সূচনালগ্ন থেকেই কোহিনূর পত্রিকা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, নবীন লেখকদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবার পাশাপাশি সমাজ ও সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল ।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত আগে ও পরে কোহিনূর পত্রিকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে কবিতা, প্রবন্ধ, সম্পাদকীয়, সংবাদ ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ। নিঃসন্দেহে এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে এবং ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে কোহিনূর পত্রিকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। আলোচ্য সংখ্যার প্রথম রচনাটি হলো ‘ফাগুন’।
সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা আজ গবেষণার বিষয়। এই পত্রিকার ওপর অনেকে কাজ করেছেন, রচনা করেছেন গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ। এদের মধ্যে ড. মাহবুবুল হক, ড. মোহাম্মদ আনোয়ার সাঈদ, শাকিল আহমদের নাম উল্লেখ করা যায়।
এ প্রসঙ্গে গবেষক ড. মাহবুবুল হক মন্তব্য করেছেন : আমাদের বিবেচনায় দুটি কারণে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘কোহিনূর‘ পত্রিকার প্রকাশ স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রথমত, ১৯৫০ সালে অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্মের প্রাথমিক কালেই পূর্ববাংলার একটি মফস্বল শহর চট্টগ্রাম থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার আবির্ভাব নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। উল্লেখযোগ্য এই কারণে, যেখানে ঢাকা থেকেই ১৯৪৯ সালের পূর্বে কোন সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত বা ছাপা হয়নি ।
দ্বিতীয়ত, কোহিনূর পত্রিকা প্রকাশের সূত্র ধরেই এই পত্রিকার সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের প্রথম বৈদ্যুতিক ছাপাখানা কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসেই (১৯২৮) ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রণীত ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ পুস্তিকা আকারে ছাপা ও বিতরণ করা হয়েছিল। আর সে কারণেই এই পত্রিকার মুদ্রাকর ও প্রকাশকের নামে মামলা দায়ের করেছিল তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ কোহিনূর পত্রিকায় ২য় বর্ষ ৩৩শ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল এভাবে : ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জের’ : ‘গত ভাষা আন্দোলন সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” পুস্তিকা ছাপাইবার অপরাধে ‘কোহিনূর’ ইলেকট্রিক প্রেসের ম্যানেজার ও সাপ্তাহিক ‘কোহিনূরে’র সহকারী মৌলবী দবীর আহামদ চৌধুরীকে মুদ্রাকর হিসাবে এবং নব নির্বাচিত মিউনিসিপ্যাল কমিশনার মৌলবী কামালুদ্দিন খাঁ বি.এ. কে প্রকাশক হিসেবে গ্রেফতার করা হইয়াছিল। প্রেসের খাতা জব্দ করা হইয়াছিল। তাঁহাদিগকে জামিন দেওয়া হইয়াছিল। বহু ঘুরা ফেরার পর গত ২৩শে অক্টোবর তারিখ ডে. মা. জনাব মৌলবী কে রহমান ছাহেবের বিচারে তাঁহারা বেকসুর খালাস পাইয়াছেন। আমরা তাহাদিগকে অভিনন্দিত করিতেছি।’