কোরবানি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে অর্থ খরচ করে স্বার্থ ত্যাগ করে এ ইবাদত করতে হয়। এতে যেমন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নাত জাগ্রত হয়। আবার ইসলামের নির্দশনও প্রকাশ পায়। কোরবানির মাধ্যমে পরিবার ও দরিদ্রজনের উপর খরচ করা হয় এবং আত্মীয়–স্বজন ও বন্ধু–বান্ধবদের জন্য হাদিয়া ও উপঢৌকন পেশ করার সুযোগ হয়। কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য করতে পেরেই মুমিন মুসলমান আনন্দলাভ করতে পারে। আর সেই খুশিই হলো কুরবানির খুশি।
আমরা জানি, নারীদের জন্য কোরবানির বিধান পুরুষের মতোই। সম্পদশালী নারীর উপরও কোরবানি ওয়াজিব। সাধারণ নিয়মে তার কোরবানি দিতে হবে। যদি তার জানার মধ্যে এবং তার সম্মতি নিয়ে পিতা স্বামী বা অন্য কেউ তার পক্ষ থেকে দিয়ে থাকে, তাহলে তার কোরবানি আদায় হবে। যেমন পুরুষের পক্ষ থেকে এ নিয়ম মেনে অন্য কেউ কোরবানি দিয়ে দিলেও তার কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। যেমন প্রবাসে থাকাদের পক্ষ থেকে দেশে কোরবানি। কোনো নারীর পক্ষে তার পিতা বা স্বামী কোরবানি করলে, কিংবা ভাগে নাম দিলে একটি ওয়াজিব হয়ে থাকলে অন্য নামটি নফল কোরবানি বলে বিবেচিত হবে। একজনের পক্ষে একটি কোরবানি ওয়াজিব। বাকিগুলো হবে নফল কোরবানি। একজনের পক্ষে একাধিক কোরবানির এটাই বিধান।
ইবরাহিম (আ.)-এর যে ত্যাগের স্মরণে কোরবানির বিধান আরোপিত হয়েছে সেই ত্যাগের অন্যতম অংশীদার ছিলেন মা হাজেরা (আ.)। যিনি আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য জনমানবহীন প্রান্তরে একাকী সন্তানকে লালন–পালন করে কোরবানির জন্য পিতার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। শয়তানের প্রতারণা উপেক্ষা করে এবং সন্তানের প্রতি মাতৃস্নেহ পেছনে ফেলে আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সামর্থ্যবান সব নারী পশু কোরবানির মাধ্যমে তার সে ত্যাগের অনুশীলন করবেন সেটিই কাম্য। সামর্থ্যবান নারীর ওপর কোরবানি অপরিহার্য। কিন্তু স্বামী, পিতা বা পুরুষ অভিভাবকের উচিত, নারীর কোরবানির ব্যবস্থা করে দেওয়া। কারণ সামর্থ্য থাকলেও অনেক নারীর পক্ষে কোরবানির ব্যবস্থাপনা অনেক কষ্টের হয়। নারী কোরবানি করতে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান না হলেও পুরুষ অভিভাবক নিজের কোরবানির পাশাপাশি নারীর পক্ষ থেকে কোরবানি করতে পারে। স্বামী নিজের কোরবানির পাশাপাশি স্ত্রীর পক্ষ থেকে কোরবানি করতে পারে। বর্তমানে আমাদের সমাজে অনেক কর্মজীবী নারী আছেন, যাঁরা বেতন ও বোনাস পেয়েছেন। কোরবানি করার আর্থিক সামর্থ্যও রাখেন। কর্মজীবী ছাড়াও অনেকে সামর্থ্যবান আছেন; কিন্তু স্বামী অথবা পিতার কোরবানি করাকেই যথেষ্ট মনে করেন। এভাবে অনেক নারীই কোরবানি না দিয়ে কোরবানির অফুরন্ত ফজিলত ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নারীদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং পুরুষদেরও ভূমিকা রাখতে হবে।
পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো কোরবানির কাজে হাত লাগানো। ঈদ–উল–আজহার কাজের পরিধি অনেক বড়। অনেক পরিকল্পনা আর কাজের ফসলে এই কোরবানি সম্পাদিত হয়। সেই মসলাপাতির আয়োজন দিয়ে শুরু। এরপর জবাই, গোশত কাটা, বন্টন, রান্না, সংরক্ষণ অবধি অনেক কাজ। এসব তদারকি কিংবা সামলাতে গিয়ে অনেক নারীর ঈদটাই মাটি হয়ে যায়। তাই এসব কাজে নারীর পাশপাশি পুরুষরাও হাত লাগালে তা সহনীয় ও সুন্দর হয়। আমরা জানি, অনেক পরিবারে এই সহায়ক প্রথা চালু আছে। তা চিরন্তন থাকুক। তবে কোন কোন জায়গায় এটিকে এখনো নারীদের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। বিষয়টা এমন নারীরা তৈরি করবেন পুরুষরা ভোগ করবেন। আমরা এখন অনেক প্রগতিশীল। ডিজিটাল যুগ পেরিয়ে স্মার্ট হবার পথে যাত্রা শুরু করেছি। আমাদের চিন্তা–চেতনাও তাই যুগোপযোগী করতে হবে। ইতিবাচক ও সহমর্মী চিত্ত নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে সকলকে। এখানে কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সহযোগী। পারস্পরিক সহযোগিতা সমপ্রীতি বাড়ায়। আর সমপ্রীতিই হলো যে কোন উৎসব–আয়োজনকে সার্থক হিসেবে তুলে ধরার মূল নিয়ামক। আমরা সকলে বিষয়টি মনে রাখি। ঈদের কাজগুলো সবাই মিলে সামলাই, ঈদের খুশি সবাই মিলে করি।
লেখক : নারীনেত্রী, লেখক ও সংগঠক।