কোরআনের কিছু অংশ মানা আর না মানা-এমন ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে ভয়ানক আযাব

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | রবিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২২ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

যারা আল্লাহর এই কিতাবকে আংশিকভাবে বর্জন করবে তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালা ভয়ানক সতর্কবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর কিতাবের একাংশ বিশ্বাস করো এবং আরেক অংশ অবিশ্বাস করো? (সাবধান!) কখনো যদি কোনো (জাতি কিংবা) ব্যক্তি (দ্বীনের অংশবিশেষের ওপর ঈমান আনয়নের) এ আচরণ করে, তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কি হবে যে, পার্থিব জীবনে তাদের লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে, পরকালেও তাদের কঠিনতম আযাবের দিকে নিক্ষেপ করা হবে; তোমরা যা করেেছা, আল্লাহতায়ালা সেসব কিছু থেকে মোটেও উদাসীন নন’- সূরা বাকারা-৮৫। শুধুমাত্র নামাজ, রোজ, হজ্ব, যাকাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর কোরআনের বিধানকে যৎ সামান্য মেনে নিয়ে যারা শিক্ষা, দর্শন, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অর্থ ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা তথা জীবনের বাস্তবতা থেকে আল কোরআনের দিক নির্দেশনা ও শিক্ষাকে বর্জন করে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের মতন ইসলাম পরিপন্থী মানবরচিত বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিজেদেরকে মুসলমান বলে ভাবছে তাদের ক্ষেত্রে কি এই আয়াতের অর্থ প্রযোজ্য নয়? মূলত তারা আত্মবিস্মৃতি কিংবা আত্মপ্রবঞ্চনা ও আত্মপ্রসাদের মধ্যেই ডুবে আছে। মদিনার দুটি বিখ্যাত গোত্রের মধ্যে যে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তা ভঙ্গ করা হয়েছিল তার ভিত্তিতেই আল্লাহতায়ালার এই আয়াতটি নাযিল হয়। মাদীনার আনসারগণের দু’টি গোত্র ছিলঃ ১। আউস ও ২। খাযরায। ইসলামের পূর্বে এই গোত্রদ্বয়ের মধ্যে কখনও কোন মিল ছিল না। পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত। মাদীনার ইয়াহুদীদের তিনটি গোত্র ছিল: ১। বানূ কাইনুকা, ২। বানু নাযীর এবং ৩। বানূ কুরাইযা। বানু কাইনুকা ও বানু নাযীর খাযরাজের পক্ষপাতি ছিল এবং তারা বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল। আর বানূ কুরাইযার বন্ধুত্ব ছিল আউসের সঙ্গে। আউস ও খাযরাযের মধ্যে যখন যুদ্ধ শুরু হত তখন ইয়াহুদীদের তিনটি দল নিজ নিজ মিত্রের সঙ্গে যোগ দিয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। দুই পক্ষের ইয়াহুদী স্বয়ং তাদেরই হাতে মারাও যেত এবং সুযোগ পেলে একে অপরের ঘর বাড়ী ধ্বংস করত এবং দেশ থেকে তাড়িয়েও দিত। ধন-মালামালও দখল করে নিত। অতঃপর যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে পরাজিত দলের ইয়াহুদী বন্দিদেরকে ইয়াহুদীরা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিত এবং বলতঃ ‘আমাদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ আছে যে, আমাদের মধ্যে যদি কেহ বন্দী হয় তাহলে আমরা যেন তাদেরকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নেই। তারই উত্তরে মহান আল্লাহ তাদেরকে বলেছেনঃ ‘এর কারণ কি এই যে, আমার এ হুকুম মানছ? কিন্তু আমি তোমাদেরকে বলেছিলাম তোমরা পরস্পর কাটাকাটি কর না, একে অপরকে বাড়ী হতে বের করে দিওনা, তা মানছ না কেন? এক হুকুমের উপর ঈমান আনা এবং অন্য হুকুমকে অমান্য করা, এটা আবার কোন ঈমানদারী?’ আয়াতে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ নিজেদের রক্ত প্রবাহিত কর না, নিজেদের লোককে তাদের বাড়ী হতে বের করে দিওনা। কেননা তোমরা এক মাযহাবের লোক এবং সবাই এক আত্নার মত। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ সমস্ত মু’মিন পরস্পর বন্ধুত্ব, দয়া ও সাহায্য-সহানুভূতি করার ব্যাপারে একটি শরীরের মত। কোন একটি অঙ্গের ব্যথায় সমস্ত শরীর অস্থির হয়ে থাকে, শরীরে জ্বর চলে আসে এবং রাতে নিদ্রা হারিয়ে যায়। (মুসলিম ৪/১৯৯৯)। এরকমই একজন সাধারণ মুসলিমের বিপদে সারা বিশ্ব জাহানের মুসলিমদের অস্থির হওয়া উচিত। যদিও এই আয়াতটি উক্ত ঘটনার প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে তথাপি এই আয়াতটি আগামী কেয়ামত পর্যন্ত সারাবিশ্বের মানবতার জন্যে জারি থাকবে। অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের কিছু অংশ মেনে নিয়ে নিজের জীবন পরিচালনা করা যেমন অসম্ভব আর কিছু অংশ না মেনে নিজেকে খাটি মুসলমান দাবী করাও অযৌত্তিক ও অসংগত। একজন মুমিনের জিন্দেগীর সমস্ত ঈমান আমল পুরোপুরি ইসলামে দাখিল করার মাধ্যমেই রয়েছে বিপুল কল্যাণ ও প্রশান্তি। তাইতো আল্লাহতায়ালা মুমিনদের উপর সেই আয়াতটি নাযিল করেছেন, ‘হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা পুরোপুরি ইসলামে দাখিল হয়ে যাও এবং কোনো অবস্থায়ই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না। অবশ্যই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন’ সূরা বাকারা-২০৮। আল্লাহর এই কোরআনকে সর্বক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাপকাঠি রূপে গ্রহণ করতে যারা আপত্তি কিংবা অস্বীকৃতি জানায় তাদের পরিচয়ও কুরআনে তুলে ধরা হয়েছে। ‘যারা আল্লাহর নাযিল করা আইনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না তারাই কাফের’- সূরা আল মায়েদা-৪৪। ‘যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না, তারাই হচ্ছে জালেম’- সূরা আল মায়েদা-৪৫। ‘যারা আল্লাহর নাযিল করা আইনের ভিত্তিতে বিচার করে না, তারাই হচ্ছে ফাসেক’- সূরা আল মায়েদা-৪৭। এই তিনটি আয়াতেই আল্লাহতায়ালা কোরআনের কিছু অংশ মানা আর কিছু অংশ না মানাকারীদের প্রতি প্রত্যক্ষভাবে ইঙ্গিত করেছেন। ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, অত্র সূরার ৪৪,৪৫ ও ৪৭ আয়াতে ইয়াহুদীদের দু’টি দলকে কাফির, যালিম এবং ফাসিক বলা হয়েছে। ব্যাপার এই যে, ইয়াহুদীদের দু’টি দল ছিল। একটি বানূ নাযীর এবং অপরটি বানূ কুরাইযা। তাদের প্রথমটি ছিল সবল এবং দ্বিতীয়টি ছিল দুর্বল। তাদের পরস্পরের মধ্যে এ কথার উপর সন্ধি হয়েছিল যে, বিজিত দলটির কোন লোক যদি পরাজিত দলটির কোন লোককে হত্যা করে তাহলে তাকে পঞ্চাশ ওয়াসাক রক্তপণ দিতে হবে। পক্ষান্তরে যদি পরাজিত দলটির কোন লোক বিজিত দলটির কোন লোককে হত্যা করে তাহলে তাকে একশ ওয়াসাক রক্তপণ দিতে হত। এ প্রথাই তাদের মধ্যে চলে আসছিল। রাসূল (সাঃ) মাদীনায় আগমনের পর এরূপ এক ঘটনা ঘটে যে, দুর্র্বল ইয়াাহুদীদের এক ব্যক্তি সবল ইয়াহুদীদের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। তখন এদের পক্ষ থেকে এক লোক ওদের কাছে গিয়ে বলে, ‘এখন একশ’ ওয়াসাক আদায় কর।’ তারা উত্তরে বলে, ‘এটা তো প্রকাশ্য অন্যায় আচরণ। আমরা তো সবাই একই গোত্রের, একই ধর্মের, একই বংশের এবং একই শহরের লোক। অথচ আমরা রক্তপণ পাব কম, আর তোমরা পাবে বেশী? এতদিন পর্যন্ত তোমরা আমাদেরকে দাবিয়ে রেখেছিলে। আমরা বাধ্য ও অপারগ হয়ে তোমাদের এ অন্যায় সহ্য করে আসছিলাম। কিন্তু এখন যেহেতু এখানে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ন্যায় একজন ন্যায়পরায়ণ লোক এসে গেছেন সেহেতু আমরা তোমাদেরকে সেই পরিমাণ রক্তপণই প্রদান করব যে পরিমাণ তোমরা আমাদেরকে প্রদান করে থাক।’ এ নিয়ে চতুর্দিকে যুদ্ধ বাধার উপক্রম হল। শেষ পর্যন্ত পরস্পরের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হল যে, রাসূল (সাঃ) কে মীমাংসাকারী নিযুক্ত করা হোক। কিন্তু সবল লোকেরা যখন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করল তখন তাদের কয়েকজন বুদ্ধিমান লোক তাদেরকে বললঃ তোমরা এ আশা কর না যে, রাসূল (সাঃ) অন্যায়ের আদেশ প্রদান করবেন। এটাতো স্পষ্ট বাড়াবাড়ি যে, আমরা দিব অর্ধেক এবং নিব পুরাপুরি! আর বাস্তবিকই এ লোকগুলো অপারগ হয়েই এটা মেনে নিয়েছিল। এক্ষণে তোমরা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে মীমাংসাকারী নির্বাচন করলে অবশ্যই তোমাদের হক মারা যাবে। কেহ কেহ পরামর্শ দিল, গোপনে কোন লোককে রাসূল (সাঃ) এর নিকট পাঠিয়ে দাও। তিনি কি ফায়সালা করবেন তা সে জেনে আসুক। সেটা যদি আমাদের অনুকূলে হয় তাহলে তো ভাল কথা। আমরা তাদের নিকট থেকে আমাদের হক আদায় করে নিব। আর যদি ওটা আমাদের প্রতিকূলে হয় তাহলে আমাদের পৃথক থাকাই বাঞ্ছণীয় হবে। এ পরামর্শ অনুযায়ী তারা মাদীনার কয়েকজন মুনাফিককে রাসূল (সাঃ) এর নিকট প্রেরণ করল। তারা তাঁর নিকট পৌঁছার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতগুলি অবতীর্ণ করে স্বীয় রাসূল (সাঃ) কে তাদের কু-মতলব সম্পর্কে অবহিত করলেন। অতএব কোরআনের কিছু অংশ মানা আর কিছু অংশ না মানাকে আল্লাহতায়ালা আগামী কেয়ামত পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন-যা প্রত্যেক মুমিনদেরকেই কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। এই ব্যাপারে কোন ছাড় নেই। নইলে কাল কঠিন হাশরের দিনে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
লেখক: সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবারণা পূর্ণিমার মাহাত্ম্য
পরবর্তী নিবন্ধঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাৎপর্য ও শিক্ষা