আমরা সম্পাদকীয়তে নিয়মিতই লিখে চলেছি সড়ক দুর্ঘটনা ও তার প্রতিরোধ প্রসঙ্গে। কিন্তু তা যেন কোনো কাজেই আসছে না। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে। গত ৮ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘মহাসড়ক নিরাপদ হবে কবে’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘নিরাপদ সড়কের দাবি যেন গুমরে কেঁদে মরছে। একদিকে অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ বা ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এই দুইয়ে মিলে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক অনিরাপদ করে তুলেছে। কোনোভাবেই থামছে না দুর্ঘটনা। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে হাটহাজারীর চারিয়া এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত হয়েছেন। এভাবেই চলতি বছর গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত দশ মাসে শুধুমাত্র ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৯৭ জন। আহতের সংখ্যা দেড় শতাধিক।
সড়কে এভাবে মর্মান্তিক মৃত্যুই যেন নিয়তি এখন। ফলে সড়কপথে ভ্রমণ করা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো– চালকের অদক্ষতা, চালকের ক্লান্তি, গাড়ির বেপরোয়া গতি এবং গাড়ির ফিটনেস না থাকা। সাধারণের মনে এখন একটাই প্রশ্ন–মহাসড়ক নিরাপদ হবে কবে? গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া চালকের দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে। মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী।’
এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বলেছে, সড়ক ও মহাসড়কের ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে বিপজ্জনক বাঁক ও ক্রসিংগুলোতে। নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও এসব দুর্ঘটনা কমছে না। এ অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর লক্ষ্যে মহাসড়কের বাঁক সরলীকরণের সুপারিশ করেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়। কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ রওশন আরা মান্নানের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য এনামুল হক, রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, মো. ছলিম উদ্দীন তরফদার, রাবেয়া আলীম ও মেরিনা জাহানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। তাঁরা বলেন, রাস্তার বাঁকগুলোতে গাছপালার জন্য এমনিতেই দেখতে অসুবিধা হয়, সতর্কতামূলক চিহ্নও পর্যাপ্ত থাকে না, পাশাপাশি বাঁকে রাস্তা যথেষ্ট প্রশস্তও থাকে না। ফলে এসব জায়গায় নানামুখী দুর্ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে মহাসড়কের বাঁকগুলো যথাসম্ভব সোজা করতে হবে। একই সঙ্গে মহাসড়কে নসিমন–করিমন চলাচল বন্ধ ও একমুখী যান চলাচলের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন তাঁরা। বৈঠকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আলোকে কাজের মান বজায় রেখে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ময়মনসিংহ কেওয়াটখালী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়।
ইতোপূর্বে আমরা পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়েছি যে, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন কিছু সুপারিশ পেশ করেছে। সংগঠনটি বলছে, দক্ষ চালক তৈরি উদ্যোগ বৃদ্ধি, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি, যানবাহন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও পথচারীদের মধ্যে ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কের স্বল্প গতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে সেগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা তৈরি, সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, গণপরিবহনের চাঁদাবাজি বন্ধ, রেল ও নৌপথ সংস্কার এবং সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো, টেকসই গণপরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এবং সড়ক পরিবহন আইন–২০১৯ বাস্তবায়ন করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে। তবে ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহন ও মোটরসাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।