জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগ্রামের কথা লেখার আহ্বান জানিয়েছেন গৃহায়ণ, গণপূর্ত এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, এ সংগ্রামে অংশ নেওয়া সমস্ত ছাত্রছাত্রী ও শহীদদের কথা লেখা হবে। আমাদের প্রতিনিয়ত যেন মনে থাকে, রক্তের ওপরে দাঁড়িয়ে আমরা আজকের বাংলাদেশে আছি। আমাদের যেন প্রতিনিয়ত মনে থাকে, যে ঐক্য রচিত হয়েছিল ৫ আগস্ট, সে ঐক্য যেন কোনো অবস্থাতেই কোনো শক্তি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা না করতে পারে। আমাদের যেন এ কথা মনে থাকে, যে কোনো দুর্বলতার সুযোগে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আগ্রাসন ও বিভিন্ন ধরনের আক্রমণের থেকে কিন্তু আমরা মুক্ত নই। গতকাল শনিবার বিকালে নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আহসান হাবীব পলাশ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বইমেলার আহ্বায়ক শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ সাহাব উদ্দীন হাসান বাবু ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ইবনে হোসাইন জিয়াদ।
আদিলুর রহমান খান বলেন, এই বইমেলার ন্যারেটিভ আলাদা হবে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটিয়ে জুলাইয়ের ৩৬ দিনে ছাত্র–জনতা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ বদলে দিয়েছে। বদলে যাওয়া ন্যারেটিভের ওপর দাঁড়িয়ে আজকের এই বইমেলা। বাংলাদেশে তো বইমেলা বায়ান্ন সাল থেকেই হচ্ছে, একুশ উদযাপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি খুবই ছোট আঙ্গিকে প্রচারণার জন্য স্মরণিকা বের করে নিজেদের পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান ছিল। ব্যাপকভাবে বাংলা একাডেমি অনেক পরে করেছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামেও অনেকদিন আগে থেকে শুরু হলেও সে সময় ছোট ছোট অঙ্গনে ছিল। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হলো সে সমস্ত উদ্যোগকে ছাপিয়ে বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার উপর দাঁড়িয়ে মানুষের অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, সেটার উপর দাঁড়িয়ে আজকের বইমেলা।
তিনি বলেন, জনতার ঐক্য, ছাত্রসমাজের ঐক্য, গণমানুষের ঐক্য বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশ যেটা আশা করে, সেটা হচ্ছে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। একুশ মানে মাথা নত না করা। আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি এবার যেন সেটা মনে রেখেই করা হয়।
সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বই পড়লে জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। পড়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই তো আমাদের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরানের প্রথম আয়াতটা কিন্তু ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’। আমাদেরকে পড়তে হবে। আজকে বইমেলাতে প্রকাশনী সংস্থাগুলো সাজিয়েছে তাদের স্টলগুলো। আপনারা সবাই কিন্তু সেখানে যাবেন এবং আমি আজকে আপনাদেরকে অনুরোধ জানাচ্ছি, সবাই কিন্তু বই কিনবেন। কারণ আপনারা না কিনলে তারা উৎসাহিত হবেন না। পরবর্তীতে তারা আরো বেশি উৎসাহিত হবেন যদি আপনারা বই কিনেন।
মেয়র বলেন, ছাত্র–জনতা–শ্রমিকের যে বিপ্লব ২০০৭ থেকে ২৪ পর্যন্ত মানুষের মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগ্রাম, সবকিছুই, জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধ থাকার কারণেই কিন্তু আমরা রাজপথে আন্দোলন করতে পেরেছি। দেখুন প্রতিটি জায়গায় কিন্তু ছাত্রদের ভূমিকা আছে। সেটা ৫২ বলুন, ৭১ বলুন, ৯০ বলুন, ২৪ বলুন। ছাত্ররাই কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। এর সাথে শ্রমিক–জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, দেশে ১৮ কোটি মানুষ। কিন্তু প্রকাশক পাঁচশ কপি বই ছাপাতে সাহস করেন না। বই কিনুন। আপনি না পড়লে বাড়ির কেউ পড়বে। তারাও না পড়লে বাসায় বেড়াতে আসবেন তাদের কেউ পড়বেন। তারা পড়লেও কিনুন। যেন আপনার বাসায় সুন্দর সুন্দর বই থাকে। বাসায় কেউ না আসলেও কিনুন, যেন আপনি বলতে পারেন বইটি আমার আছে। বই না কিনলে প্রকাশকরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। একটা ইন্ডাস্ট্রি হারিয়ে যাবে। প্রকাশক এবং তার পেছনে যে লোক আছেন তাদের উজ্জীবিত করতে বই কিনুন।
তিনি বলেন, সংস্কৃতি ভাষাকে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে রাখা হয়েছিল, এটা একটি কৃত্রিম ভাষা হয়ে গিয়েছিল। আমরা আইনগুলোকে জনগণ থেকে দূরে রাখতেই যেন নিয়ম করেছি, সাধু ভাষা ছাড়া আমরা আইনের ভাষা লিখব না। এই উদ্দেশ্য বলে দিচ্ছে, জনগণ থেকে আইনটা দূরে রাখলাম।
মো. আহসান হাবীব পলাশ বলেন, লেখকদের কাছে অনুরোধ থাকবে পাঠকের কথা ভেবে বই লিখুন। আমরা পাঠকরা যেভাবে চাই সেভাবে লিখুন। তিনি বলেন, আমাদের আইনের বইগুলো, আমাদের সংবিধান এমনভাবে লেখা, যেন ধরে নেওয়া হয় এগুলো আমরা সাধারণ মানুষ না জানি, আমরা না পড়তে পারি। খুব সাধারণ একজন মানুষ কেন সংবিধান ভালোভাবে পড়তে পারবে না? কেন আইনের সিআরপিসি, পেনাল কোড বা এভিডেন্স অ্যাক্টের বইগুলো পড়তে পারবে না? অনেক কষ্টে ক্লাস করে করে আমরা কিছু বোঝার চেষ্টা করি এগুলো। উপদেষ্টা মহোদয়কে অনুরোধ করব, এই বইগুলো সাধারণের জন্য পাঠযোগ্য করা হোক, আনন্দের সঙ্গে যেন পড়তে পারি সেরকম ব্যবস্থা করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা ড. কিসিঞ্জার চাকমা, শিক্ষা কর্মকর্তা রাশেদা আক্তার, সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের আলী প্রয়াস ও সিডিএ বোর্ড মেম্বার জাহিদুল করিম কচি।
এদিকে অতীতে চট্টগ্রামে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বইমেলা শুরু হতো। এবারই প্রথম ঢাকার সাথে মিল রেখে ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে। প্রথম দিন ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ স্টল প্রস্তুত হলেও বেশ কিছু স্টলে চলছে সাজসজ্জার কাজ। মেলায় প্রচুর দশনার্থী দেখা গেছে। তবে বিকিকিনি প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা।
বইমেলার আয়োজক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। তবে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, নাগরিক সমাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং শিল্প–সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করছেন। মেলা প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা ও ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। মেলা চলবে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ২৬ দিনব্যাপী এবারের মেলায় চট্টগ্রাম ও ঢাকার ১০৭ প্রকাশনা সংস্থার ১৪০টি স্টল রয়েছে।