এখন আষাঢ় মাস। লিখছি তৃতীয় দিনে। ঝরঝর মুখর বাদল ধারায় পথ–ঘাট, খাল– বিল, নালা–নর্দমা অথৈই পানিতে টুই–টুমবর। কোন কোন জায়গায় পথ–ঘাট পানিতে প্লাবিত, হচ্ছে। এই হচ্ছে বর্ষার রূপরেখা। তবে একসময়ে প্রকৃতির মাঝে বর্ষা ঋতু এক অপরূপ সৌন্দর্যের মহিমা পরিলক্ষিত হতো। পত্র পল্লব বর্ষার বারিধারার স্নানে মোহনীয় হয়ে উঠতো। কবি, সাহিত্যক, গীতিকার, সুরকার, চিত্রকার বর্ষা ঋতু নিয়ে লিখেছেন, গেয়েছেন, এঁকেছেন। শতকথা শতগীত।
কিন্তু এখন গ্রামে বলুন বা শহরে বলুন ইট– পাক্কেল, দালান– কোটার ফোকর দিয়ে সবুজ প্রকৃতির, আকাশের রোদ, বৃষ্টি, মেঘের খেলা অবগাহন করা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। ছেলে বেলায় ভারী বর্ষণে জমে থাকা পানিতে কতকাগজের নৌকা বানিয়ে জলে ছেড়েছি। হাত–তালি দিয়ে, হৈ–হুল্লোড় করেছি। জমে থাকা পানিতে পা চুবিয়ে পানি ছিটিয়ে সাথিরা কত খেলেছি। লুকিয়ে লুকিয়ে বৃষ্টি পানিতে ভিজেছি। কানমলা, চিকন বাঁশের বেত (চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ছিবা) দিয়ে উত্তম, মধ্যম খাওয়া। আবার সন্ধ্যা বেলায় জানালার পাশে বসে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ রোমন্থন করতে করতে সরিষার তেল দিয়ে কাঁচা লংকা, পেঁয়াজ কুচি মাখিয়ে মুড়ি খাওয়া আহা: কি অমৃত। রাত গভীর হতে না, হতে লন্ঠন নিভিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বেঙ্গমা–বেঙ্গমীর ( রূপকথার গল্প) শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া। এসব এখন আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। মায়ের মুখে শুনেছিলাম, অতিরিক্ত বৃষ্টির পানিতে কোন কোন গ্রামাঞ্চলে পাহাড়ী ঢলে বন্যার সৃষ্টি হতো। আমার নানার বাড়ি নাইখাইন (পটিয়া থানা) সেখানে পাহাড়ী ঢলে বন্যা হলে ৫–৬ দিন স্থায়ী হতো। এলাকার মানুষ ঘর– বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতো। কিন্তু আমার নানী একা চৌকিদার কে দরজার মুখে উচুঁ স্থানে বসিয়ে রেখে নিজে একটি চোকির উপড়ে কেরাসিনের সটৌপ (চুলা), এক কলসি পানি, ম্যচ, চেরাগ, লন্ঠন, চা পাতা, বেলা বিস্কুট, দুধ পাউডার, চিনি। এসব সরঞ্জাম নিয়ে খাটের উপরে বাসস্থান তৈরি করে পানি বন্ধী থেকে বাড়ি পাহারা দিতেন। কথিত আছে, বন্যার পানিতে নৌকাযোগে একদল ডাকাত নানীর দৌড়গোড়ায় এসে দরজায় আঘাত করতে থাকে।
নানীর সাথে ডাকাত দলের অনেক বাকবিতণ্ডা হয়। একসময়ে সাহসের সাথে হুংকার দিয়ে নানী ডাকাত দলকে তাঁড়ায়। এমন অনেক গ্রামাঞ্চলে বর্ষার ভারী বর্ষণে বন্যার গল্প আছে। কিন্তু এখন গ্রাম আর আগের মতো নেই। দালান–কোটা, পাকা রাস্তা, বেড়িবাঁধ সবমিলিয়ে বর্ষার ঢলে আর বন্যা নেই। এখন বন্যা হচ্ছে শহরে অলি–গলি, নালা–নর্দমা বাসস্থানে। ময়লা আবর্জনা নিদ্দিষ্ট স্থানে না ফেলায়, নালা নর্দমা ভরাট হয়ে ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে প্রতিনিয়ত জনসাধারণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। কোন কোন জায়গায় নোংরা পানির নিচে মানুষ কে বসবাস করতে হচ্ছে। কোথায় সেই বর্ষার আনন্দ, অপরূপ সৌন্দর্য নতুন প্রজন্মরা অবগাহন করবে। আমাদের কে এগিয়ে আসতে হবে। ইট–পাটকেলের ঘর–বাড়ি সীমিত করে বেশি বেশি গাছ–পালা লাগিয়ে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।