কথা কাটাকাটি, একে অপরকে বিদ্রুপ করে কথা বলা, র্যাগ দেওয়া ও শাটলে সিট ধরাসহ বিভিন্ন বিভাগের নানা অনুষ্ঠানে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বার বার সংঘর্ষে জড়াচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ উপ-গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এতে একদিকে
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, অপরদিকে ক্ষতি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি।
মূলত দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিয়েছে শাখাটিতে। অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবেই চলছে শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। বার বার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নিষিদ্ধের পরও বগিভিত্তিক উপ-গ্রুপগুলো তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে বগির নামে। কোনোভাবেই যেন বগির সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছে না চবি ছাত্রলীগ।
উপ-গ্রুপগুলোর দাবি পূর্ণাঙ্গ কমিটির কারণেই বার বার সংঘর্ষ হচ্ছে। এতে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। বাড়ছে হতাশা-ক্ষোভ। এ সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সেটা থেকে ফলপ্রসূ কোনো সমাধান আসেনি। অনেক সময় দেখা যায় এসব ঘটনায় বহিষ্কার করলেও মানবিক আবেদনে সেটি মওকুফ হয়ে যাচ্ছে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে শাখা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সদিচ্ছা থাকলে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে কোনো বাধা নেই। কেন্দ্র থেকে পুরোপুরি সহযোগিতা রয়েছে বলেও জানান শাখাটিতে সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ নাজমুল।
সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার শহীদ আবদুর রব হলের দোকানে বিজয় গ্রুপের মাহমুদুল হাসান রুপক নামে এক কর্মীর সাথে বাজে আচরণ ও মারধর করে সিএফসির কর্মীরা। তবে সিএফসির দাবি তাকে চাঁদাবাজির জন্য শাসন করা হয়েছে। এরপর ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে সন্ধ্যার পরে আমানত হলে সিএফসি ও সোহরাওয়ার্দী হলে অপরপক্ষ অবস্থান নেয়। এরপর থেমে থেমে সংঘর্ষ চলতেই থাকে। এ দিন রাতে প্রায় ছয় বার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় সোহরাওয়ার্দী হল ও আমানত হলের মাঝের রাস্তা ইট, পাথর, কাঁচ ও টাইলসের টুকরোয় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষ চলাকালে বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি করে একে অপরকে। এ সময় উভয় পক্ষকে দেশীয় অস্ত্র হাতে দেখা যায়। এ ছাড়া রাতের ট্রেনে সিএফসির এক কর্মীকে মারধরের ঘটনায় স্টেশন চত্ত্বরে অবস্থান নেয় সিএফসি। দুই হলে প্রায় ১২টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডি অনেক চেষ্টা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। এ সময় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরাও সিএফসি কর্মীদের পাথরে আহত হন। পরে রাত সাড়ে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী ও শাহ আমানত হলে পুলিশের সহায়তায় তল্লাশি চালায় প্রক্টরিয়াল বডি। এ সময় বেশ কিছু দেশীয় অস্ত্র রাম দা, কিরিচ, বটি, গুলতি উদ্ধার করে প্রক্টরিয়াল বডি।
এর আগে গত মঙ্গলবার তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবাদের সূত্রপাত হয় শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক বিজয় ও সিএফসির মধ্যে। পরে সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী হলে বিজয় ও আমানত হলে সিএফসি অবস্থান নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। বিবদমান এই পক্ষ শিক্ষা উপ-মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে অনুসরণ করে। ক্যাম্পাসে বিজয় সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইলিয়াসের ও সিএফসি সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের নেতৃত্ব রয়েছে।
এর আগে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সিঙটি নাইনের জুনিয়র এক কর্মীকে র্যাগ দেয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায় বগিভিত্তিক সিঙটি নাইন ও এপিটাফ। খবর ছড়িয়ে পড়লে সিঙটি নাইনের কর্মীরা সূর্যসেন হলে আক্রমণ করে। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এছাড়া সূর্যসেন হলের দরজা, জানালা ও বাইক ভাঙচুর করে সিঙটি নাইনের কর্মীরা। পরেরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত তিন বছরে এ রকম প্রায় ২০০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছে অন্তত শতাধিক নেতাকর্মী। ভাঙচুর হয়েছে ৫টি হল। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকা সম্পত্তি। এ সব ঘটনায় অনেককে সাময়িক বহিষ্কার করলেও সেটা পরে মানবিক আবেদন দেখিয়ে মওকুফ করে দেয় প্রশাসন৷
দীর্ঘদিন কমিটি না থাকা, আধিপত্য বিস্তার, প্রশাসনের বিচারহীনতা এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এমন সংঘর্ষ লেগেই আছে বলে মনে করেন বিভিন্ন উপ-গ্রুপের নেতারা। তবে শাখা সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের দাবি এটার সাথে পূর্ণাঙ্গ কমিটির কোনো সম্পৃক্ততা নাই। যারা সংঘর্ষ করছে তারাই ক্যাম্পাসে ফাও খায় এবং চাঁদাবাজি করে। এ ছাড়া জামায়াত-শিবিরের অনুপ্রবেশকারী চক্র এখনো যড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে দাবি সভাপতির।
বিভিন্ন উপ-গ্রুপের বক্তব্য: বিজয় পক্ষের নেতা মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, সভাপতি রেজাউল হক রুবেল উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে কমিটি পেছানোর জন্য ঝামেলা করছেন। আমরা চবি ক্যাম্পাসে রুবেলমুক্ত ছাত্রলীগ চাই। কমিটি না দিলে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নেব৷
ভার্সিটি এঙপ্রেস উপ-গ্রুপের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয় বলেন, প্রায় তিন বছরেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে না পেরে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নিয়ন্ত্রণে নেই। যার কারণে বিভিন্ন সময় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
রেড সিগনাল উপ-গ্রুপের নেতা রকিবুল হাসান দিনার বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্তরা চাইলেই পারে কমিটি করতে। পরিচয় থাকলে তার বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবস্থা নেয়া যায়। আর অনেকেই বয়স বেড়ে যাওয়ায় হতাশায় রয়েছে। বাংলার মুখের নেতা আবু বরক ত্বোহা বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের রাজনীতি দুই মেরুকরণে বিভক্ত। একটি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন অপরটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। এই দুইটি গ্রুপ আবার ১১টি উপ-গ্রুপে বিভক্ত। নানা সময় সংঘাতের কারণে কমিটি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এ শাখার নেতাকর্মীরা। গত পাঁচ বছরে এ শাখার কমিটি হয়েছে মাত্র দুইবার। ২০১৫ সালের ২০ জুলাই আলমগীর হোসেন টিপু সভাপতি এবং এইচ এম ফজলে রাব্বি সুজনকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘাতের কারণে দুই দফা স্থগিতের পর ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর দেড় বছরেরও বেশি সময় পর ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই রেজাউল হক রুবেল সভাপতি এবং ইকবাল হোসেন টিপুকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই সদস্য করে কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার কথা থাকলেও প্রায় তিন বছরেও পূর্ণাঙ্গ হয়নি কমিটি। এতে বাড়ছে হতাশা, ক্ষোভ আর দায়িত্বহীনতা। যার থেকেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়াচ্ছে বলে মনে করছেন উপ-গ্রুপগুলোর নেতারা। এ পর্যন্ত কয়েক দফা পূর্ণাঙ্গ ও হল-অনুষদ কমিটির লক্ষে জীবনবৃত্তান্ত ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ থেকে প্রত্যয়পত্র আহ্বান করা হয়।
এ নিয়ে গত ১৩ জানুয়ারি সাংগঠনিক দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমবারের মতো চবি ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক সফরে আসেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রতিনিধি দল। কেন্দ্রীয় নেতারা ক্যাম্পাসে আসলে তাদের পথ অবরুদ্ধ করে পূর্ণাঙ্গ কমিটির দাবিতে প্ল্যাকার্ড ও স্লোগান দেন পদপ্রত্যাশীরা। ওইদিন চবিতে আসেন শাখা সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ সম্পাদক হায়দার রহমান জিতু ও উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ নাজমুল। তারা ২৫ জানুয়ারির মধ্যে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করবেন বলে আশ্বাস দেন সভাপতি রেজাউল হক রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুকে। কিন্তু আজও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি।
কেন্দ্রীয় নেতার বক্তব্য : কেন চবি ছাত্রলীগের কমিটি পূর্ণাঙ্গ হচ্ছে জানতে চাইলে চবি শাখার সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ নাজমুল আজাদীকে বলেন, সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের সদিচ্ছা থাকলে কমিটি আরও বহু আগে হয়ে যেত। কেন্দ্র থেকে সব ধরনের সহযোগিতা রয়েছে। আমরা বলেছি কমিটি করে আনতে, কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অনুমোদন দিয়ে দিবেন। সেটা তারা করতে পারেনি। দীর্ঘদিন রাজনীতি করলে সবার একটা প্রত্যাশা থাকে। পূর্ণাঙ্গ কমিটির না থাকায় ক্ষোভ-হতাশা বাড়ছে।
সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য : অভিযোগ অস্বীকার করে শাখা সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, সংঘর্ষের ঘটনার সাথে পূর্ণাঙ্গ কমিটির কোনো সম্পৃক্ততা নাই। আবদুর রব হলে একটা ছেলে চাঁদাবাজি করতে গেছে, আমাদের ছেলেরা প্রতিহত করেছে। তাদের (বিজয় গ্রুপ) উদ্দেশ্য ভালো মনে হচ্ছে না। তাদের দুষ্কৃতকারীরা সহযোগিতা করছে মনে হচ্ছে।
নতুবা এ রকম বার বার ঝামেলা করতো না। বাকিরা কিন্তু করছে না। পূর্ণাঙ্গ কমিটির ব্যাপারে তিনি বলেন, এই মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। এ ব্যাপারে সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, সংঘর্ষগুলো বগির নাম দিয়ে হচ্ছে। অল্পতেই একে অপরকে অস্ত্রের আঘাত করছে। এটা আসলে তদন্তের বিষয়, যে তাদের উদ্দেশ্য কী। এ রকম ঘটনা তো আসলে ছাত্রলীগের আদর্শের সাথে যায় না। তিনি বলেন, আমাদের কমিটির প্রক্রিয়া চলছে। কমিটি হয়ে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, সংঘর্ষের পর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমরা পুলিশের সহায়তায় চবির দুটি আবাসিক হলে তল্লাশি চালাই। এ সময় আমরা দুই হল থেকে রাম দা, কিরিচ, গুলতি, কাঁচের বোতল ও রডসহ বিভিন্ন প্রকার দেশিয় অস্ত্র উদ্ধার করেছি।
তিনি বলেন, যেহেতু আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি, তাই আমাদের পুরো বিষয়টা সমাধান করতে আরেকটু সময় লাগতে পারে। তবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।