প্রতিদিনই আমরা কোনো না কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদের মুখোমুখি হই। আমাদের পড়তে হয় মানুষের অনেক অসহনশীল আচরণের খবর। আমরা পড়েছি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে চলন্ত কারে হঠাৎ আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। ২৬ এপ্রিল রাত ৮ টার দিকে উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়ন বাণীগ্রাম নতুন বাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটেছে। তবে আগুনের ঘটনা দেখে স্থানীয়রা এগিয়ে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এছাড়া আজাদীতে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় পাহাড় থেকে এক যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে থানা পুলিশ। ২৬ এপ্রিল বিকেল ৪টার দিকে উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকার পাহাড়ে এ ঘটনা ঘটে। তথ্যমতে, যুবকের নাম মো. ইমন (২০)। তিনি ওই বটতলী ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মো. ছৈয়দুল হকের ছেলে।
সাম্প্রতিক সময়ে খুন, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টাসহ নানান অপরাধ যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্রের পাতা এবং টেলিভিশনের পর্দা খুললেই দেখা যাচ্ছে এ–সংক্রান্ত নানান খবর। এর সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংগঠনগুলোর পেশি আস্ফালন, দুর্বৃত্তদের দুর্বৃত্তপনা, কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানও আশঙ্কার। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ‘তিন মাসে সহিংসতায় ২৩ জন নিহত, আহত ২৩৬৮’। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় গত তিন মাসে নানা রকম সহিংসতা হয়েছে অন্তত ২৬৮টি। এসব সহিংসতায় নিহত হয়েছে ২৩ জন, আহত হয়েছে অন্তত ২ হাজার ৩৬৮ জন। এ ছাড়া এ সময়ে যৌন হয়রানিকেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছে ৭৯ জন নারী–পুরুষ, যাদের মধ্যে হামলার শিকার ৫৫ জন নারী ও ২৪ জন পুরুষ।
উল্লেখ্য, দেশে সার্বিক অপরাধপ্রবণতার কোনো একক চিত্র পাওয়া যায় না। নেই কোনো সমন্বিত জরিপও। এরপরও সামপ্রতিক বেশ কিছু ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য এবং বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া, যৌতুক, মাদক, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, প্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্যক্তিগত স্বার্থ, সুস্থ বিনোদনের অভাব, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাব কাজ করছে। পরিবারে শারীরিক–মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের দেশে বেশিরভাগ পরিবারে ব্যক্তির মানসিক সমস্যাগুলো সেভাবে চিহ্নিত করা হয় না। এ কারণে তারা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছেও যান না। ফলে মানসিক সমস্যা ও সমাজের বিভিন্ন বিশৃঙ্খল পরিবেশ পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। তবে পরিতাপের বিষয়, সমাজ ও পারিবারিক পর্যায়ে সংঘটিত সহিংসতার সঠিক চিত্রটি অজানা, যা অনভিপ্রেত।’ তাঁদের মতে, শুধু আইন থাকলেই হবে না; সে আইন বাস্তবায়ন জরুরি। দেশে দীর্ঘ দিন ধরে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা অপরাধ না কমে আরো বাড়বে বৈকি। আইন থাকলেও অনেক সময় পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা থানা–আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। বেশির ভাগ ঘটনাই স্থানীয় সালিসে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কিন্তু এই সমঝোতার বৈঠকেও ঘটলো নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এই সহিংসতা আমাদের পশ্চাৎপদ সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোর ফল। এর থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। আর এটি করতে না পারা মানবিক এবং আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।
কেন বাড়ছে খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা– এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধীরা এতটাই বেপরোয়া যে, তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এটা বলা যায় যে স্বার্থচিন্তা, অসংযত লোভ এবং নানা ভেদজ্ঞানই হয়তো মানুষকে ক্রমাগত সংকীর্ণ ও অসংযত হওয়ার পথে ঠেলতে ঠেলতে চরম অসহনশীল করে তুলেছে। সহনশীলতা একটি সামাজিক মূল্যবোধ এবং এটা মানুষের একটি গুণ। অবশ্য সব মানুষের মধ্যে এই গুণ দেখা যায় না। কেউ হয়তো জন্মগতভাবে বা পারিবারিক অনুশাসনের মাধ্যমে এই গুণের অধিকারী হয়, আবার কেউবা শিক্ষার মাধ্যমেও এটা আয়ত্ত করতে পারেন বা করেন। এই গুণের চর্চাও বিভিন্ন পর্যায়ে হতে পারে। পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রের বৃহত্তর পরিসরে সহনশীলতার চর্চা কিন্তু অপকারের চেয়ে উপকারই বেশি করে।’ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না ঘটে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আমরা চাই, নাগরিকদের সুখ শান্তি এবং স্বস্তি।