কেউ ফিরেছেন খালি হাতে, কেউ পেয়েছেন অল্প মাছ

নিষেধাজ্ঞার পর সাগরে গিয়ে বৈরি আবহাওয়ার মুখে জেলেরা বড় জাহাজ থেকে বোট সব নৌযান ফিরে এসেছে

হাসান আকবর | সোমবার , ১৬ জুন, ২০২৫ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

সাগরে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা ৬৫ দিন থেকে কমিয়ে ৫৮ দিন করায় খুশি ছিলেন জেলেরা। ৫৮ দিন শেষ হওয়ার সাথে সাথে মধ্যরাতে অনেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন সাগরে। কিন্তু বড় বড় ঢেউয়ের তোড়ে মাছ শিকার তো দূরের কথা, জীবন নিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন সকলে। চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় এলাকার কয়েক হাজার জেলে সাগরে মাছ ধরতে গেলেও নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে এসেছেন অনেকটা শূন্য হাতে। তিন দিনের পোড়ানো তেলের খরচ তোলার মতো মাছও শিকার করা সম্ভব হয়নি।

গতকাল রোববার সন্ধ্যার আগে অত্যাধুনিক বড় জাহাজ থেকে শুরু করে বোট পর্যন্ত সাগরে মাছ শিকারে নিয়োজিত সকল নৌযান ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শিকার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাজারে মাছের দাম বেড়ে গেছে। এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৬শ টাকা দরে। কিছুটা বড় সাইজের মাছের দাম আরো বেশি। সাগর শান্ত হওয়ার পর বাজারে মাছের দাম কমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছিল সরকার। তবে এই সময়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে নিষেধাজ্ঞা থাকত না। ফলে ওই দেশের জেলেরা মাছ শিকার করত। এতে করে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞাটা পুরোপুরি কার্যকর হতো না। ভারতীয় জেলেদের অনেকে বাংলাদেশের জলসীমায় এসে মাছ ধরে নিয়ে যেত বলে অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছর থেকে ভারতের সঙ্গে মিল রেখে ১৫ এপ্রিল থেকে ৫৮ দিন নিষেধাজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ৬৫ দিন থেকে কমিয়ে ৫৮ দিন নির্ধারণ করায় জেলেরা খুশি হন। চলতি বছরের গত ১৫ এপ্রিল থেকে ৫৮ দিন সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকায় মাছ ধরা, পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে। ১১ জুন মধ্যরাতে ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হলে অনেক জেলে ওই রাতে সাগরের পথে নৌযান ভাসান। কেউ কেউ যাত্রা করেন ১২ জুন সকালে। উৎসবমুখর পরিবেশে বিপুল মাছ শিকারের আশা নিয়ে জেলেরা সাগরে গেলেও মাঝপথে তাদের আশাভঙ্গ হয়। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের কবলে পড়েন তারা। একপর্যায়ে সাগরে টিকতে না পেরে ফিরে আসতে বাধ্য হন অত্যাধুনিক ফিশিং জাহাজ থেকে শুরু করে ট্রলার পর্যন্ত সব নৌযান। গতকাল সন্ধ্যার আগে সকল নৌযান মূলত উপকূলে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে।

জেলেদের বরাত দিয়ে সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ, বৈরী আবহাওয়া ও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে মাছ শিকার করা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি জালসহ বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্ট রক্ষা করতে সকলে কূলে ফিরে আসতে বাধ্য হন।

কর্ণফুলী নদীর উজানে এসে মাছ ধরার অনেক জাহাজ ও ট্রলার আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নিয়েছে আনোয়ারা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও সীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকায়ও। কূলে ফিরে আসা জেলেরা জানান, তারা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সমুদ্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন মাছ ধরার আশায়। কিন্তু মাঝ সমুদ্রে পৌঁছে তারা পড়েন প্রবল ঢেউয়ের কবলে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছিল নৌযানে। অবস্থা নাজুক হওয়ায় তারা ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

চট্টগ্রামের একাধিক ট্রলার মালিক বলেন, ১৫ দিনের জন্য সাগরে যাত্রা করেছিল তাদের নৌযান। কিন্তু তিন দিনের মাথায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। এতে যে পরিমাণ তেল পোড়ানো হয়েছে সেই তেলের দাম তোলার মতো মাছও কোনো ট্রলার আনতে পারেনি।

ট্রলার মালিক এস এম মামুন মিয়া গতকাল আজাদীকে জানান, সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। ওখানে টিকতে না পেরে জেলেরা ফিরে এসেছেন। তেমন মাছ আনতে পারেননি। কোনো কোনো ট্রলার শিকার শুরু করার আগেই পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।

মহেশখালীর এক জেলে ইউসুফ আলী টেলিফোনে বলেন, মাঝ সমুদ্রে গিয়ে দেখি সাগর ভয়াবহ রকমের উত্তাল। ঢেউয়ের উচ্চতা ছিল ৮১০ ফুট। এমন ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই ফিরে এসেছি।

চট্টগ্রামের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রগুলোতে দেখা গেছে, অনেক ট্রলার আবার জেটিতে ভিড়েছে। মাছ খুব একটা ধরা না পড়ায় হতাশ জেলেরা। কেউ কেউ খালি হাতে ফিরে এসেছেন, আবার কেউ কেউ সামান্য কিছু ছোট মাছ নিয়ে উপকূলে ফিরেছেন।

মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাগরে মৌসুমি নিম্নচাপ ও শক্তিশালী বায়ুচাপের প্রভাবে উত্তাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আবহাওয়ার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত গভীর সমুদ্রে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জেলেরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার সময় তারা ঋণ করে সংসার চালিয়েছেন। মাছ শিকার করে সেই ঋণ পরিশোধের আশা ছিল। কিন্তু এখন নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, আবহাওয়া কখন ঠিক হবে তা অনিশ্চিত। এতদিন বন্ধ থাকার পর সাগরে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসতে বাধ্য হওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাবেন।

এদিকে সাগরে মাছ শিকার দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামের বাজারগুলোতে কোল্ড স্টোরেজের মাছ বিক্রি হচ্ছে। নতুন করে মাছ আসবে এমন আশায় বাজার পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেও জেলেরা শূন্য হাতে ফিরে আসায় মাছের দাম আবারো বাড়তে শুরু করেছে। ভর মৌসুমে বাজারে নেই পর্যাপ্ত ইলিশ। কোল্ড স্টোরেজে জমা করে রাখা আগের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এত চড়া দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে যে, তা মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। একদেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৬শ থেকে ১৮শ টাকায়। অন্যান্য মাছের দামও বাড়তির দিকে। সাগরের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে মাছ শিকার পুরোদমে শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত বাজারে চড়া ভাব থাকবে বলে সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।

আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। এই অবস্থা আরো কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইরান-ইসরায়েলের মুহুর্মুহু আক্রমণ
পরবর্তী নিবন্ধপতেঙ্গা সৈকত রক্ষায় একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত