বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হলো কৃষি। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ এবং শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়ন- কৃষি ভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। কৃষি এখনো দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা এবং অধিকাংশ জনগণই জীবন জীবিকা ও কর্মসংস’ানের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই কৃষিভিক্তিক শিল্পে স্বল্পমাত্রার সঞ্চালনা ও প্রেষণাই আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে এবং গ্রামীণ জনগণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষিশিল্পের উন্নয়ন জরুরি। এ খাতকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করার জন্যই কৃষি সেক্টরের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার অর্জন করেছে।
করোনাভাইরাস-এর সংক্রমণের কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এর ধাক্কা এসে পৌঁছায় গত বছরের মার্চ মাসের প্রথমার্ধে। ধীরে ধীরে করোনা বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ মহামারি আকার ধারণ করে। বাংলাদেশেও জ্যামিতিক হারে আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানুষের মধ্যে কাজ করছে এক অজানা শত্রুর আতঙ্ক ও অসহায়ত্ব। জাতিসংঘের মহাসচিব বর্তমান করোনা পরিসি’তিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সংঘটিত সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক ও মানবিক সংকট হিসেবে বর্ণনা করেছেন। পৃথিবীর প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ করোনার আক্রমণ থেকে বাঁচার আশায় স্বপ্রণোদিত গৃহবন্দিত্বের জীবন বেছে নিয়েছে। এমন বিপর্যয় উত্তরাধুনিক সভ্যতার প্রত্যেক মানুষের কাছে ছিল অকল্পনীয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মধ্যচীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। সংগত কারণেই করোনাভাইরাস এবং এর সংক্রমণরোধে গৃহীত ব্যবস্থার কারণে বিশাল প্রভাব পড়েছে কৃষি এবং কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর। করোনার সংক্রমণের প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক প্রভাব যে দীর্ঘমেয়াদি হবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই পরিসি’তিতে কৃষির উৎপাদন অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ড. এম. আফজাল হোসেন পত্রিকান্তরে বলেন, করোনা পরিসি’তি এবং পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে টেকসই খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। পরিবর্তিত পরিবেশে কৃষিব্যবস’ার উন্নয়ন ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বারোপ করতে হবে। বিষয়গুলো হলো : কৃষকের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ অথবা বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক এবং জমি চাষের, ফসল কাটার ও ফসল মাড়াই কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ এবং সরবরাহ নিশ্চিত করা। সেচের অভাবে যাতে কোনো জমির ফসল নষ্ট না হয় সে জন্য সেচসুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দেশের সব পতিত জমি কৃষিযোগ্য জমিতে পরিণত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস’া গ্রহণ করা। জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ এক জমিতে চার ফসল উৎপাদন, দানাদার বিভিন্ন ফসল ছাড়াও ফলমূল, বাদাম, ডাল ও তেলজাতীয় শস্য, সবজি চাষ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন ও মাছ চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলা। নগর কৃষি ও ছাদ বাগানে ফল ও সবজি চাষের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে বাগান পরিকল্পনা ও সৃজন করা প্রয়োজন। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকদের আগাম তথ্য প্রদানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কৃষিকাজে ব্যবহৃত কৃষি উপকরণের দাম বাজারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা। কারণ উচ্চমূল্যে কৃষি উপকরণ কিনলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশ হয়ে যাবে। কৃষকের উৎপাদিত ফসল যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে উৎপাদিত ফসলের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। কৃষককে কৃষিকাজে খাদ্যশস্য উৎপাদনে উৎসাহিত করার ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে তাকে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকারিভাবে বেশির ভাগ ফসল ক্রয়, গুদামজাত ও বিক্রির ব্যবস’া করা প্রয়োজন। তা ছাড়া অনলাইন পোর্টাল করে অথবা ফেসবুক গ্রুপ করে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এছাড়া কৃষিখাতে আধুনিকায়নে খরচ কমাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং কৃষির যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষিখাতে আরও বেশি হারে কর্মসংস’ানের সুযোগ বাড়ানোর জন্য কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন প্রয়োজন।