কৃষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ড. মো: জামাল উদ্দিন | বুধবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

’চতুর্থ শিল্প বিপ্লেেবর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্‌বান আহবান জানান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গত ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২৪তম জাতীয় সম্মেলন এবং ইনস্টিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিইবি) বাংলাদেশের ৪৩তম কাউন্সিলের ভার্চুয়াল উদ্বোধনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আরও বলেন, কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হওয়ায় দেশের জনগণকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। এখন থেকে আমাদের সকলকে মিতব্যয়ী হতে হবে, সঞ্চয় করতে হবে এবং কখনই কোনো কিছুর জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। আর উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমরা যাতে সব সময় নিজেদের খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখার কথা পূনরাবৃত্তি করে তিনি আরও বলেন, যতটা সম্ভব সবজি ও ফল চাষ করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমাদের পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যেতে হবে এবং আমরা তা করতে পারলে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।’
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ কিন্তু এটি আরেকটি নতুন নবজাগরণের দিকনির্দেশনা। এই বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ যতটা কঠিন ততটাই সফল। তাই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধিকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এই বিপ্লবের বাধা দূর করতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সব দেশে সমানভাবে গড়ে উঠছে না, ফলে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই এ খাতে বড় ধরনের বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। কৃষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে কারিগরি শিক্ষা, জ্ঞান, দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধার অভাব; হাই-টেক প্রযুক্তির প্রতি অনীহা; ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের অর্থ বিনিয়োগে সামর্থ্যের অভাব; হাই-টেক প্রযুক্তি স্থানান্তরে মোটিভেশন জটিলতা, কর্মহীন হয়ে পড়ার ভয়, দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সাথে সমন্বয়-সাধন এবং অভিযোজন জটিলতা, প্রযুক্তি বিকেন্দ্রীকরণের সমস্যা; প্রযুক্তি ব্যবহারে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা বা সাইবার ভীতিতে ভোগা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। আমাদের দক্ষ ও উপযোগী মানবসম্পদ তৈরি করে এগিয়ে যেতে হবে। সারাদেশে কারিগরি ও কৃষি শিক্ষা ব্যাপক প্রযুক্তিগত পরিবর্তন লক্ষণীয়। দক্ষ মানব সম্পদ ছাড়া প্রযুক্তি নির্ভর সমাজে এগিয়ে যাওয় কঠিন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব একটি ডিজিটাল বিপ্লব। রোবোটিঙ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অফ থিংস এবং কোটি কোটি স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ এবং কম্পিউটারে ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার বিশ্বজুড়ে একটি নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে, যাকে বলা হয় ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াব ২০১৬ সাল থেকে প্রথম এই বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। বর্তমানে সারা বিশ্বে এ বিষয়ে বিভিন্ন চিন্তভাবনা, বিচার-বিশ্লেষণ, চ্যালেঞ্জের মোকাবেলার উপায় এবং ২১ শতকের চাহিদার মূল্যায়ন নিয়ে আলোচনা চলছে।
কৃষিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল হাই-টেক প্রযুক্তির প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা সম্পন্ন মানব-সম্পদ গড়ে তোলা এবং কৃষকদের সে সুযোগের প্রাপ্যতা ও ব্যবহার নিশ্চিত করা। কৃষকদের দ্বার প্রান্তে সেসব সুযোগ বা সুফল পৌঁছানো এবং তাদেরকে এসব প্রযুক্তি সর্ম্পকে আগ্রহী করা তোলা। কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশেরই কারিগরি শিক্ষার মাত্রা খুবই কম। গ্রামের সাধারণ কৃষক এখনো এসব উচ্চ প্রযুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নহে। কৃষিতে কারিগরি ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে কৃষক পরিবারের নতুন প্রজন্মকে টার্গেট করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় এই সমস্ত প্রযুক্তির বিষয় তুলে ধরে ধীরে ধীরে তাদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনয়ন জরুরি। কৃষিতে ড্রোনের ব্যবহার, নির্ভুল তথ্য সংগ্রহে জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং এর ব্যবহার, ন্যানো-টেকনোলজির ব্যবহার, প্রিসিশন এগ্রিকালচার, রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস এসব জ্ঞান ও প্রযুক্তি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবেরই অংশ।
কৃষিতে বাস্তবায়নযোগ্য হাই-টেক প্রযুক্তির সুফল সর্ম্পকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সে সাথে দক্ষ শিক্ষক তৈরির কোন বিকল্প নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা ও পরিবেশ তৈরি গেলে অদূর ভবিষ্যতে এর সুফল মিলবে। ভবিষ্যতে বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবেলায় সৌরবিদ্যুতের উপর জোর দেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে উচ্চ-প্রযুক্তি ব্যবহার ও সূফল সর্ম্পকে প্রচার চালানো দরকার। হাই-টেক প্রযুক্তির প্রতি কৃষকদের অনীহা দূর করতে এর সুফল সম্পর্কে কৃষকদের সচেতন করতে হবে। সেই সাথে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মীদের ব্যাপক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এতে সময় লাগবে, কিন্তু আমরা এখনই প্রস্তুতি না নিলে ভবিষ্যৎ কৃষি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।
বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিক কৃষির বিকল্প নেই। আধুনিক কৃষি মানে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার। প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানো একটি চ্যালেঞ্জ। দেশের ৭০%-এর বেশি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। উচ্চ প্রযুক্তির পেছনে অর্থ ব্যয় করার মানসিকতা বা আর্থিক সামর্থ্য তাদের নেই। এটি সমাধানের জন্য আমাদের প্রথমে সার্মথ্যবান কৃষকদের টার্গেট করতে হবে। বিশেষ করে কৃষক সংগঠন এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের হাই-টেক কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণের কথা মাথায় রাখতে হবে। বর্তমানে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের এনএটিপি-২ প্রকল্পের অধীনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের নিয়ে যে সিআইজি (কমন ইন্টারেস্ট গ্রুপ) বা সংগঠন গঠিত হয়েছে যা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরেও কৃষক সংগঠনগুলিকে টেকসইভাবে টিকিয়ে রাখা জরুরী। তাদের মাধ্যমে হাই-টেক প্রযুক্তি গ্রহন ও বিস্তার সহজ হবে। ফলাফল বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।
কৃষিতে উচ্চ প্রযুক্তি চালু হলে অনেকেই চাকরি হারানোর ভয় পান। এটা সত্য. তবে এটাও সত্য যে সনাতণী কাজের পদ্ধতিগুলি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবস্থাপনার জন্য কাজের অনেক নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে দক্ষ লোকবলই কাজের সুযোগ পাবে। তাই কৃষি কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি জরুরী। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কয়েকটি দক্ষতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে তা হলো- খাপ-খাওয়ানোর সক্ষমতা, যোগাযোগ দক্ষতা, ক্রিটিক্যাল থিংকিং, ক্রিয়েটিভিটি, প্রোভলেম সলভিন বা জটিল সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা, সমন্বয়-সাধন, কোলাবোরেশন এবং নিগোশিয়েশন উল্লেখযোগ্য। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আগামী দুই দশকের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেশিনের মাধ্যমে ৪৭ শতাংশ মানুষের চাকরি প্রতিস্থাপিত হবে। তাই এখনই সময় আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নতুন উচ্চ-দক্ষ শ্রমবাজারের জন্য প্রস্তুত করা।
কৃষিতে ৪.০ আইআর বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আইসিটি-ভিত্তিক সমন্বিত মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে কৃষকদের এর সুবিধা ও ব্যবহার উপযোগীতা সম্পর্কে অবগত করা; শ্রমজীবী মানুষের বেকারত্ব সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ; কৃষি-বান্ধব অ্যাপসগুলিকে একীভূত করে ব্যবহার সহজতর করা; এসব অ্যাপ অফলাইনে যাওত ব্যবহার করা যায় সেটির ব্যবস্থা করা; বিভিন্ন মিডিয়াতে এসব অ্যাপস এর ব্যবহার বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা করা; কৃষিতে উদ্ভাবনী বা সৃজনশীল কাজের জন্য তহবিল গঠন করা এবং উপযুক্ত ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করা; হাই-টেক প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করা যায় সে বিষয়ে প্রায়োগিক গবেষণা জোরদার করা; কৃষি বিভাগ বা সংস্থায় আইসিটি বিভাগ/ উইং খোলা বা জোরদার করা তথা সুযোগ-সুবিধা উন্নততর করা এবং দক্ষ জনবল তৈরি করা প্রয়োজন। সর্বোপরি, কৃষক পর্যায়ে সাইবার ভীতিকে সাইবার প্রীতিতে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত কর্ম-পরিকল্পনাসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে ভবিষ্যতের কৃষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অনেক সহজতর হবে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বারি; হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধমুজিব হত্যায় বাঙালির ইতিহাসের দায়