শারদীয় দুর্গোৎসব এর অন্যতম আকর্ষণ মহাঅষ্টমীর কুমারী পূজা। কুমারী পূজা সম্পর্কে দেবী পূরাণে উল্লেখ রয়েছে। কুমারী পূজা প্রসঙ্গে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব বলেছেন–সব স্ত্রী লোক ভাগবতীর এক একটি রূপ। শুদ্ধত্মা কুমারীতে ভাগবতীর রূপ বেশী প্রকাশ। কুমারী পূজার মাধ্যমে নারী জাতি হয়ে উঠবে পূত পবিত্র ও মাতৃভাবাপন্ন। সবাই শ্রদ্ধাশীল হবে নারী জাতির প্রতি। ১৯০১ সালে ভারতীয় দার্শনিক ও ধর্ম প্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ সর্বপ্রথম কলকাতার বেলুর মঠে নয় জন কুমারী দিয়ে পূজার মাধ্যমে এ কুমারী পূজার পুনঃপ্রচলন করেন। অবশ্য এখন সেখানে একজন কুমারীকেই পূজা করা হয়। তখন থেকে দুর্গা পূজায় প্রতি বছর কুমারী পূজা হয়ে আসছে। পূজার আগ পর্যন্ত কুমারীর পরিচয় গোপন রাখা হয়। তন্ত্রশাস্ত্র মতে কুমারী পূজা হলো অনধিক ষোল বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। শাস্ত্র মতে কোলাসুরকে বধের মধ্য দিয়েই কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়। এক সময় কোলাসুর স্বর্গ মর্ত্য দখল করে নেয়। দেবগন নিরুপায় হয়ে মহাকালীর শরণাপন্ন হন। দেবগনের আবেদনে দেবী পুর্নজন্মে কুমারী রূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকে মর্ত্যলোকে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়। কুমারী পূজার কোন জাতি ধর্ম বর্ণ ভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে কোন কুমারীই পূজনীয়। তবে সাধারণত ব্রাহ্মন কুমারী কন্যার পূজা বেশি প্রচলিত। বিশ্বব্রহ্মান্ডে যে ত্রিশক্তি বলে সৃষ্টি স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে সে ত্রিশক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী হলো প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়।
পৌরাণিক কাহিনী মতে এ ভাবনায় ভাবিত হয়ে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শী জ্ঞানে পূজা করেছিলেন।
এক থেকে ষোল বছর পর্যন্ত কুমারী মেয়েরা পূজার উপযুক্ত।
মেরুতন্ত্র অনুসারে জানা যায়–সর্ব কামনা সিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণ কন্যা, যশোলাভের জন্য ক্ষত্রিয় কন্যা, ধনলাভের জন্য বৈশ্য কন্যা এবং পুত্র লাভের জন্য শুদ্র কন্যা কুমারী পূজার জন্য যোগ্য। তবে সাধারণত সর্বমঙ্গলের জন্য ব্রাহ্মণ কন্যাই কুমারী পূজার জন্য বেশি মনোনীত করা হয়। বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন–এক বছরের কন্যা সন্ধ্যা, দুই বছরের কন্যা সরস্বতী, তিন বছরের কন্যা ত্রিধামূর্তি,…এগারো বছরের কন্যা রুদ্রানী,… ষোল বছরের কন্যা অন্নধা বা অম্বিকা। কুমারী মেয়েকে মনে করা হয় পবিত্রতা ও ন্যায়ের প্রতীক। সনাতন ধর্মে নারীকে শ্রেষ্ঠ আসনে বসানো হয়েছে। নিজেদের পশুত্বকে সংযত রেখে নারীকে সম্মান জানাতে হবে এটাই কুমারী পূজার লক্ষ্য। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ মতে রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গা পূজা করার বর্ণনা পাওয়া যায়। শরৎকাল দেবতাদের নিদ্রার কাল। রাবনের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাম ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগ্রত করেন। দেবী ব্রহ্মাকে বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে বললেন। তখন দেবতারা মর্ত্যলোকে এসে দেখেন এক দুর্গম স্থানে এক বেল (বিল্ব) গাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে ঘুমিয়ে আছে এক তপ্তকাঞ্চন বর্ণা বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন এই বালিকাই জগজ্জননী মা দুর্গা। ব্রহ্মা বোধনস্তবে তাকে জাগ্রত করলেন। ব্রহ্মার বোধন স্তবে জাগ্রত দেবী বালিকা মূর্তি ত্যাগ করে চন্ডিকা মূর্তি ধারণ করলেন। কুমারী পূজা হলো কুমারী রূপের নারীকে দেবী রূপে সম্মান জানানো। কুমারী নারীকে দেবী দুর্গার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের সমাজে ও দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা অন্যায় অবিচার অনৈতিকতা যেভাবে বাড়ছে, নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে সেখানে কুমারী পূজার শিক্ষা নিয়ে নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে নারীর প্রাপ্যটুকু ফিরিয়ে দিতে পারলে সমাজে শান্তি ফিরে আসবে নিঃসন্দেহে।