ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম

কীর্তিমানদের চোখে

মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান | রবিবার , ২৪ জুলাই, ২০২২ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

‘ড. আবদুল করিম’ – ভারত উপমহাদেশ বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস গবেষণায় একটি অপরিহার্য ‘অধ্যায়’ বা ‘নায়ক’ এর নাম। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতে – “ভারতের মুসলিম শাসন কালের ইতিহাসের গবেষনায় ড. আবদুল করিম এর গবেষণালব্ধ তথ্য ও বর্ণনা তাঁর পূর্বে রচিত অন্য সব ইতিহাসবিদদের কাজকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গেছে। নিষ্ঠাবান গবেষকদের গবেষণা কাজের জন্য প্রচুর খোরাক তিনি উদ্ধার করেছেন, রেখে গিয়েছেন। বিশেষ করে বাংলার মুসলিম শাসন কালের গবেষকরা ড. আবদুল করিমের কাজের পরে কোন রকম তথ্য উপাত্তের অভাব অনুভব করার সুযোগই পাবেন না। এভাবেও বলা যায় যে, বাংলার মুসলমান শাসনের ইতিহাস গবেষণায় ড. আবদুল করিমের কাজকে উপেক্ষা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়”।
ড. আবদুল করিম নিজেই অকপটে স্বীকার করেছেন – চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত এলাকা বাঁশখালীর চাপাছড়ি গ্রামে সাধারণ ধর্মভীরু মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। নিরহংকারী জ্ঞানভারে ন্যুব্জ এই মনীষী শিশুকাল থেকেই নিজের শিক্ষক, সহপাঠী, শিক্ষার্থী, সহকর্মীদের নিকট উদাহরণযোগ্য চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায় – “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানসহ স্নাতকোত্তর পাস করার পর সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য বিভাগীয় শিক্ষকরা পরামর্শ দিলেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে জানালাম, সুযোগ পেলে আমি বিভাগেই যোগদান করতে চাই। এতে বিভাগীয় প্রধান এ. এইচ. দানী সহ সবাই বিস্ময়ের সাথে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন”। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি পুনরায় বলেছেন – “শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ প্রাপ্তির পর শিক্ষার্থীদের নিকট তাদের প্রাপ্তি তুলে দেয়ার জন্য সদা সজাগ ও আন্তরিক ছিলাম। সেই কর্মটি সঠিকভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্যই সারা জীবন সাধনা করেছি এবং তাতেই আমি আজকের অবস্থানে এসে পৌছেছি। আমার সামনে উপবিষ্ট শিক্ষার্থীদের খোরাক তুলে দেয়ার যে কাজে আমি ঝাপিয়ে পড়েছিলাম তাতে স্রষ্টা দয়া করে আমাকেও কম দেন নি, বলা যায় ‘অনেক”।
এখানে তাঁকে নিয়ে বিশিষ্ট কয়েকজনের মন্তব্য উল্লেখ করা হলো –
ব্যারিস্টার জমীর উদ্দিন সরকার : “আমি শিক্ষা মন্ত্রী থাকাকালে (১৯৯২-১৯৯৬) অপরিসীম পাণ্ডিত্ব এ উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম ইতিহাসবিদ বিবেচনায় তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক করার প্রস্তাব দেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিশেষ কারণে তাতে ব্যর্থ হই। আমার এ দুঃখটা তাঁকে জানালে তিনি বলেন, ‘আমি কপালে বিশ্বাস করি, কপালে ছিল না বলেই আমার জন্য তা হয়ে উঠে নাই, আপাতত: তোমার চেষ্টাটাই আমার প্রাপ্তি’।
চ.বি-র সাবেক উপাচার্য জাতীয় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন (বার.এট.ল) : আবদুল করিম সারা জীবন গভীর নিষ্ঠা ও পান্ডিত্যসহকারে দুর্গমনীয় সুলতানি ও মোগল আমলের ইতিহাসের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে গিয়েছেন। বাঙালি জাতি তাঁর এই অতুলনীয় অবদানকে চিরকাল কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে।
সাবেক ভি.সি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী : ড. করিম উপাচার্য থাকাকালে বিশ্ব বরেণ্য পদার্থ বিজ্ঞানী নোবেল বিজয়ী ড. আবদুস সালামকে এক বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে ডি.এস.সি উপাদি প্রদান করেন যা উপমহাদেশে প্রথম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি একটি স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে চিরকাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে। .. .. .. .. “ইতিহাসের অতি গুরুত্বপুর্ণ শাখা মুদ্রা বিজ্ঞানে তাঁর বিশেষ অবদানের জন্য All India Numismatic Society কর্তৃক তাঁকে সর্বোচ্চ পদক Akbar Silver Medal প্রদান করা হয়।
সাবেক ভিসি অধ্যাপক আর. আই. চৌধুরী : তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ও সফল শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এস.এম হলের আবাসিক টিউটর থাকাকালে ছাত্রদের আবেগ ও সমস্যা তিনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট সব সময় সহানুভূতিশীল মন নিয়ে তুলে ধরতেন”। … “শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে আমরা নবীন শিক্ষকদের নিকট তিনি একজন আদর্শ ব্যক্তি ছিলেন। মুষ্টিমেয় যে কয়জন গবেষক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম”।… “প্রশাসক হিসেবে তাঁর সিদ্ধান্ত নেয়ার দ্রুততা, ক্ষমতা ও প্রজ্ঞা আমাকে সবসময়েই অভিভূত করেছে। মতপার্থক্য, সংঘাত ও বিভিন্ন সংঘর্ষকে তিনি অতি সহজেই সমাধান করতে পারতেন। ফাইল ওয়ার্ক তাঁর অপূর্ব ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট তাঁর নখদর্পণে ছিল। অপূর্ব তাঁর স্মরণশক্তি ছিল”।
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম : “বাংলার ইতিহাসে ড. আবদুল করিমের অবদান অসামান্য। এ বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা সভা হওয়া প্রয়োজন, শুধু ছাত্র -শিক্ষক গবেষকদের জন্য নয়, শিক্ষিত সমাজ ও সাধারণের জন্যও”।
ড. করিমের বিলেতে গবেষণার সুপারভাইজার প্রফেসর হ্যারিসন এর একটি মন্তব্য নিম্নরূপ :
“The writing of this valuable thesis, together with Dr. Karim’s regular and valued contributions to our seminars might have seemed work enough for two years and ample evidence of his tireless thoroughness. But during this stay he has also amassed a store of materials of other studies which seem likely to be of even wider interest than those he has already completed. Dr. Karim has unearthed materials on the old Mughal District of Dacca which should help recreate a detailed picture of Mughal administration in Bengal, throw unexpected light upon the development of the city and provide for a deeper understanding of the early years of British administration. Supplemented as I hope this may be from the district records and the family archives of the Zamindari families. Dr. Karim will be in a position to inaugurate a series of local studies of the sort which have so enriched British or European history. Here is whole new field of studies of great interest in themselves and of special enthusiasm and insight to equip him well for leadership in the such an enterprise”.
লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল এণ্ড আফ্রিকান স্টাডিজের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ের প্রফেসর এ. এল ব্যাসাম ড. করিম সম্পর্কে লিখেন –
“It shall be noted that Dr. Karim has been invited to remain in this country for some time after completing his thesis in order to assist with the preparation of a source book of South Asia History covering the Muslim period. This is a measure of the regard in which his scholarship is held at this school.
ইতিহাসবিদ আবদুল মোমেন চৌধুরী : “বাংলার সুলতানদের মূদ্রার বিশ্লেষণে নলিনীকান্ত ভট্টাশালীর পর আবদুল করিমের অবদানই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং এখনো পর্যন্ত তাঁর ‘কর্পাসই’ এ বিষয়ে প্রামাণিক গ্রন্থ। মধ্যযুগীয় বাংলার সামাজিক ইতিহাসের উদো্যক্তা হিসেবে এবং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক নতুন পর্ব সংযোজনের জন্য ড. আবদুল করিমের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে”। …“আবদুল করিমের মতো আরবি ও ফার্সী ভাষায় ব্যুৎপত্তি নিয়ে, মুদ্রা বা শিলালিপির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মানসিকতা সম্পন্ন গবেষক করিমের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অভাব এখন একান্তভাবে অনুভুত হচ্ছে।”
সুখময় মুখোপাধ্যায় : ড. আবদুল করিমের লিখা ‘বাংলার ইসিহাস – সুলতনী আমল’ বই্‌িট প্রমাণ করে তিনি একজন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, আরবী ও ফারসী ভাষায় সুপণ্ডিত। মুসলমানী আমলে মুদ্রা ও শিলালিপি সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ এবং ‘বাংলা’ তাঁর মাতৃভাষা বলে বাংলা সূত্রও তিনি ব্যবহার করতে সক্ষম। কাজেই এ জাতীয় বই লেখার জন্য তিনি যে অত্যন্ত যোগ্য লোক তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাইটির মধ্যে যেমন বহু নতুন তথ্য সংগৃহীত হয়েছে তেমনি ওসবের বিশ্লেষণ ও সত্য নির্ধারনের ক্ষেত্রেও লেখক অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ড. করিমের এই বইটি খুবই অসামান্য এবং বাংলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একটি দিক নির্দেশক স্তম্ভ বলে গন্য হতে পারে।
অধ্যাপক সুনীতি ভূষণ কানুনগো : তাঁর ইচ্ছা ছিল দেশ বিদেশের খ্যাতিমান ইতিহাসবিদদের নিয়ে আমার থিসিসের পরীক্ষা কমিটি গঠন করবেন। তাঁর এই প্রয়াস সফল হয়েছিল। আমিই প্রফেসর করিমের তত্ত্বাবধানে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভের দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হলাম। …ব্যক্তিগত জীবনে করিম স্যার আমুদে ও পরিহাস প্রিয় ছিলেন। .. .. .. “তাঁর আচার আচরণের মধ্যে অহংকারবোধের কোন স্থান ছিল না”। .. .. .. “বিলাস বহুল জীবন যাপনে তাঁর কোনদিনই আকর্ষণ ছিল না। বাসাতে তিনি অত্যন্ত সাধারণভাবেই থাকতেন। এই সাধারণ জীবনযাপন তাঁর অসাধারণ কর্মকাণ্ডের ভিত্তি স্বরূপ ছিল”। উপসংহারে বলা যায় – ড. আবদুল করিম এর বিশাল গবেষণা কর্মের সব দিকগুলো এই স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা মোটেই সম্ভব নয়। তাঁর কাজের পরিধি বহুমুখী। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় – বাংলা সাহিত্যের কালক্রম; The Rohingyas; মুসলিম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য; আবদুল করিম সাহিক্য বিশারদ জীবন ও কর্ম; আবদুল হক চৌধুরী ও তাঁর গবেষনা কর্ম; চট্টগ্রামের ইসলামী ঐতিহ্য; ঢাকাই মসলিন; মক্কা শরীফে বাঙালী মাদ্রাসা; বকশী হামিদ মসজিদ; বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সমাজ ও জীবন-১ম খণ্ড; সমাজ ও জীবন-২য় খণ্ড ইত্যাদি বইয়ের রচনার মধ্য দিয়ে।
সুতরাং, আমরা ধরেই নিতে পারি, ড. আবদুল করিম এবং তাঁর গবেষণালব্ধ কাজ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
মনীষী প্রফেসর ড. আবদুল করিম – সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রফেসর ইমেরিটাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় – এর জন্ম ০১ জুন ১৯২৮ । মৃত্যু ২৪ জুলাই ২০০৭। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাব্রতী

পূর্ববর্তী নিবন্ধমূল হোতাসহ গ্রেপ্তার ৫ স্থায়ী বহিষ্কার ২
পরবর্তী নিবন্ধশতাধিক বিতর্কিত ব্যক্তি কাউন্সিলর তালিকায়